বুধবার, ১০ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

পুলিশ ৯৯ ভাগই ভদ্র

যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি

পুলিশ ৯৯ ভাগই ভদ্র

রাজপথের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশি আচরণের সংস্কারের জন্য ডেমোক্রেটরা কংগ্রেসে ‘জাস্টিস ইন পোলিশিং অ্যাক্ট ২০২০’ শিরোনামে বিল উত্থাপনের দিনই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বললেন, ‘পুলিশ কর্মকর্তাদের ৯৯ ভাগই খুবই ভদ্র এবং দায়িত্বের প্রতি নিষ্ঠাবান।’ ট্রাম্পের আইনমন্ত্রী বিল বার বললেন, ‘গুটিকয় দুষ্ট কর্মকর্তার জন্য সবাইকে অভিযুক্ত করার অবকাশ নেই।’ অর্থাৎ জাতীয়ভাবে গড়ে ওঠা একটি দুর্বার আন্দোলনের প্রতিও ন্যূনতম শ্রদ্ধা জানানোর মনোভাব দেখা গেল না ট্রাম্পের মধ্যে। তবে তার রিপাবলিকান পার্টির অনেক সিনেটর ও কংগ্রেসম্যান জনতার আন্দোলনের সঙ্গে ইতিমধ্যে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। কেউ কেউ পুলিশি বর্বরতা এবং বর্ণবাদ নির্মূলের মিছিলেও শরিক হয়েছেন। উল্লেখ্য, ২৫ মে মিনেসোটা স্টেটের মিনিয়াপলিস সিটির একটি স্টোরে ২০ ডলারের জালনোট দিয়ে কিছু কেনার অভিযোগে সেখানকার পুলিশ গ্রেফতার করে ৪৬ বছর বয়সী জর্জ ফ্লয়েডকে। হাতকড়া পরানোর পর ফ্লয়েডকে রাস্তায় ফেলে দিয়েই তার ঘাড়ে হাঁটু চাপা দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হয়। ঘটনাটি পরদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশের পর আমেরিকাজুড়ে তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে। চতুর্দশতম দিবস অর্থাৎ ৮ জুনেও অর্ধশত সিটিতে পুলিশের ওই বর্বরতার নিন্দা, প্রতিবাদ এবং পুলিশি আচরণ ঢেলে সাজানোর দাবিতে স্লোগান অব্যাহত রয়েছে। পুুলিশ বাহিনী ভেঙে দেওয়া অথবা বাজেট কমিয়ে দেওয়ার স্লোগানও উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রে চলমান এই বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। আর আমেরিকায় পুলিশের বর্বরতা, অসদাচরণ রুখে দেওয়া, ঘাড়ে চাপপ্রয়োগ নিষিদ্ধ করাসহ নাগরিক অধিকার ভঙ্গের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও বিচারের পথ সুগম করতে ‘জাস্টিস ইন পোলিশিং অ্যাক্ট ২০২০’ শীর্ষক এ বিল এনেছে ডেমোক্রেটরা। এদিকে, আমেরিকার সমাজে ‘বর্ণবাদের বিষ’ ছড়িয়ে গেছে মন্তব্য করে সিনেট সংখ্যালঘিষ্ঠ নেতা চাক শুমার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “আইনটিকে বাস্তবে রূপ দিতে সিনেটের ডেমোক্রেটরা সর্বশক্তি দিয়ে লড়বে।” এদিকে, ফ্লয়েডকে ঘাড়ে হাঁটুচাপা দিয়ে হত্যা মামলার প্রধান অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক চৌবিনকে (৪৪) সোমবার মিনিয়াপলিস কোর্টে হাজির করা হয় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। এটি ছিল তার মামলার প্রথম শুনানির দিন। দীর্ঘ ১৮ বছরের পুরনো এই পুলিশ কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে ফ্লয়েডকে হত্যার দ্বিতীয় ডিগ্রির অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে ৪০ বছরের কারাদন্ড হবে। সংক্ষিপ্ত এ শুনানিকালে বিচারক জিনিস রেডিং তাকে সোয়া মিলিয়ন ডলার বন্ডে জামিনের নির্দেশ দেন। এর আগে ছিল পাঁচ লাখ ডলার। মামলার অভিযোগ গুরুতর হওয়ায় জামিনের অর্থের পরিমাণ দ্বিগুণ করা হলো। এই মামলার অপর তিন পুলিশ অফিসারের জন্যও মিলিয়ন ডলার ধার্য করা হয়েছে জামিনের জন্য। চৌবিনের পক্ষে আদালতে ছিলেন অ্যাটর্নি ইরিক নেলসন। মামলার পরবর্তী তারিখ ২৯ জুন বেলা দেড়টায়। এদিকে, মিশিগানের ডেট্রয়েট সিটি থেকেও ৮ জুন কার্ফিউ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন মেয়র মাইক ডোগান। এ সিটিতেও বিক্ষোভের সময় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর এবং লুটতরাজের ঘটনা ঘটেছিল। পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে কদিনের কর্মসূচির সময়। ফ্লয়েডকে সমাহিত করা হচ্ছে মঙ্গলবার দুপুরের পর টেক্সাসের হিউস্টন সিটিতে মায়ের কবরের পাশেই। এ উপলক্ষে সোমবার সারা দিনই তার কফিন ওপেন করা ছিল সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেনও গিয়েছিলেন কফিনে শ্রদ্ধা জানাতে। এর আগে তিনি ফ্লয়েডের পরিবারের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক কথা বলে তাদের সান্ত্বনা দিয়েছেন এবং আর কোনো ফ্লয়েড যাতে এভাবে পুলিশি বর্বরতার শিকার না হয় সে ব্যাপারে ডেমোক্রেটরা পুলিশি আইন সংস্কারে বদ্ধপরিকর বলে উল্লেখ করেন বাইডেন। এ দিন হাজার হাজার শোকার্ত মানুষ এসেছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে।

গত কয়েক বছরে পুলিশি বর্বরতায় নিহত কৃষ্ণাঙ্গদের স্বজনরাও এসেছিলেন সহমর্মিতা জানাতে এবং চলমান আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে।

নাগরিক সাংবাদিকতার পুরস্কার চাই

এদিকে, বিশ্বব্যাপী বর্ণবাদবিরোধী এবং পুলিশি বর্বরতা নির্মূলের দাবিতে চলমান আন্দোলনের মূল মাধ্যম অর্থাৎ ফ্লয়েডকে হাঁটুচাপা দিয়ে প্রায় নয় মিনিটের সেই নির্মমতার দৃশ্য সেলফোনের ভিডিওতে ধারণকারী ১৭ বছরের স্কুল ছাত্রী (কৃষ্ণাঙ্গ) ডার্নোলা ফ্রেজিয়ারকে আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা মানবাধিকার সংগঠক ও শ্রমিক-অধিকার শিক্ষক ড. পার্থ ব্যানার্জি। নিজের ফেসবুকে ৮ জুন প্রদত্ত স্ট্যাটাসে পার্থ ব্যানার্জি উল্লেখ করেছেন, কৃষ্ণাঙ্গী মেয়ে হাইস্কুল ছাত্রী ডার্নেলা ফ্রেজিয়ার মিনিয়াপলিস শহরে চোখের সামনে জর্জ ফ্লয়েডের ওপর সশস্ত্র পুলিশের বীভৎস অত্যাচার এবং অবশেষে হত্যা সম্পূর্ণ ঘটনাটি তার ফোনে ভিডিও রেকর্ডিং করে রাখে। সেই ভিডিওর শক্তি এমনই, যা এখন সারা আমেরিকায় এবং বলতে গেলে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে মার্কিন রাষ্ট্রযন্ত্র, শাসকশ্রেণি এবং তার পুলিশের বর্ণবিদ্বেষ, নিপীড়ন এবং প্রতিদিনের নির্মম হত্যার জীবন্ত মানবিক দলিল। তার ভিত্তিতেই উত্তাল জনরোষ, এবং এই করোনাভাইরাস সংকট উপেক্ষা করে ঐতিহাসিক জনআন্দোলন। এই নাগরিক সাংবাদিকতা, নতুন প্রজন্মের বিবেক এবং সাহসকে অত্যাচারী শাসকশ্রেণি ভয় পায়। এখন ডার্নেলা এবং তার মা আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছেন, কারণ তাদের এখন জীবনের আশঙ্কা। ডার্নেলা এ ঘটনার সাক্ষী থেকে এবং এই হত্যা প্রত্যক্ষ করে ট্রমা (যন্ত্রণার) শিকার। আমরা চাইব, দেশে দেশে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যেন এই মেয়েটির কথা সবাইকে বলে, এবং তার মতো সাহসী নাগরিক সাংবাদিকতার আশ্রয় নিয়ে শাসকশ্রেণির হিংসা, নিপীড়ন এবং দুর্নীতি ফাঁস করে দেয়। আমরা ডার্নেলার এই বৈপ্লবিক অ্যাক্টিভিজমকে কুর্নিশ জানাই। চেষ্টা করছি তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার। যে পুরস্কারের নাম হতে পারে ‘জর্জ ফ্লয়েড সিটিজেন জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ড’। তবে জানি না, মূলস্রোত মাধ্যম এবং তাদের অছি করপোরেট বিশ্ব এবং শাসক শ্রেণির রাজনীতি তা করতে দেবে কিনা।

সরব নিউইয়র্ক

এদিকে, ৮১ দিনের লকডাউন শেষে ৮ জুন নিউইয়র্ক সিটি সচল হওয়ার প্রথম ধাপে পদার্পণের পর স্টেট গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমো এবং সিটি মেয়র বিল ডি ব্লাসিয়ে পৃথক পৃথকভাবে নগরবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, তারা সবাই সজাগ থাকায় করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। এখনো তাদের একই আন্তরিকায় দিনাতিপাত করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে করোনা আর মহামারীতে রূপ নিতে পারবে না এই সিটিতে। নিজের, পরিবারের, প্রতিবেশী এবং গোটা সমাজের মঙ্গলে সব নাগরিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন বলে তারা আশা পোষণ করেছেন।

নিগৃহীত ৩০০ সাংবাদিক

জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে চলমান বিক্ষোভ কর্মসূচির সংবাদ কভারকারি সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যানসহ গণমাধ্যমের তিন শতাধিক কর্মী পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে সিপিজে অভিযোগ করেছে। ইউএস প্রেস ফ্রিডম ট্র্যাকার কর্তক সংগৃহীত তথ্য উদ্ধৃত করে সিপিজে স্থানীয় সব প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে পেশাগত দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকদের যেন হয়রানি, গ্রেফতার কিংবা বাধা প্রদান করা না হয়। এ ছাড়া কারফিউ চলাকালেও গণমাধ্যম কর্মীরা যাতে অবাধে দায়িত্ব পালন করতে পারেন সেদিকেও পুলিশ প্রশাসনকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছে সিপিজে (কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস)। এ সময়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় দায়ীরা যাতে শাস্তির আওতায় থাকে-সে ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে ৭ জুন প্রদত্ত এক বিবৃতিতে। নিউইয়র্কভিত্তিক এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মকর্তারা বলেছেন, ১২৫টিরও বেশি অঘটন ঘটেছে। যার ভিকটিম হয়েছেন সাংবাদিকরা। গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নিউইয়র্কে বাংলাদেশি দুই সাংবাদিক (হাসানুজ্জামান সাকি, সময় টিভি এবং মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ইসলামিক টিভি) ও বিক্ষোভে ঘাপটি মেরে থাকা লুটেরা শ্রেণির লোকজনের হামলার শিকার হয়েছিলেন ম্যানহাটানে লুটতরাজের ছবি ধারণের সময়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর