বৃহস্পতিবার, ১১ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা
সংসদে প্রধানমন্ত্রী

একটি মানুষও যেন কষ্ট না পায় চেষ্টা করে যাচ্ছি

নিজস্ব প্রতিবেদক

একটি মানুষও যেন কষ্ট না পায় চেষ্টা করে যাচ্ছি

সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, করোনাভাইরাস আমাদের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছে। যারা দিন এনে দিন খায়, তাদের অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েন। তাঁদের প্রত্যেককে খুঁজে বের করে সাহায্য পৌঁছে দিয়েছি। অর্থ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। দেশের একটি মানুষও যেন কষ্ট না পায়, খাদ্যের অভাবে না থাকে, সে চেষ্টা করে যাচ্ছি।

গতকাল জাতীয় সংসদে আনীত শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে গতকাল সংসদের বাজেট অধিবেশনের শুরু হয়।  অধিবেশনের শুরুতেই চলতি সংসদের এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লার মৃত্যুতে আনীত শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হয়। এতে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও অংশ নেন সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা ও সাবেক প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, করোনাভাইরাসে মরি, গুলি  খেয়ে মরি, অসুস্থ হয়ে মরি, মরতে একদিন হবেই। এই মৃত্যু যখন অবধারিত, সেটাতে তো ভয় পাওয়ার কিছু  নেই। আমি ভয় পাইনি। কখনো ভয় পাব না। আর আমি যখন বাংলাদেশে ফিরে আসি সেটা ছিল সেই বাংলাদেশ  যেখানে আমার বাবা-মা, ভাই ও শিশু ভাইটিকে পর্যন্ত হত্যা করা হয়। আমাদের পরিবারের বহু সদস্য বুলেটবিদ্ধ। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী বুলেটবিদ্ধ, অনেকে স্পিøন্টার নিয়ে বেঁচে আছেন। সংসদ নেতা আরও বলেন, আল্লাহ মানুষকে কিছু কাজ দেন, সেই কাজটুকু করতে হবে। সেই কাজ যতক্ষণ শেষ না হবে, ততক্ষণ আমি কাজ করে যাব। যখন সময় শেষ হয়ে যাবে আমিও চলে যাব। এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তিনি আরও বলেন, এই দুর্যোগের সময় অনেক দেশ সংসদে বাজেট দিতে পারছে না। আমি বলেছি, না একদিকে করোনা মোকাবেলা করব, অন্যদিকে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপনটা যাতে চলে, তারা যেন কষ্ট না পায়, সেজন্য যা করণীয় সেটা আমি করে যাব। আমি তো এখানে অনন্তকাল বেঁচে থাকার জন্য আসিনি। আমি তো জীবনটা বাংলার মানুষের জন্য বিলিয়ে দিতেই এসেছি। কাজেই এটা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। চলুন, সবাই মিলে আল্লাহর কাছে দোয়া করি এই করোনাভাইরাসের হাত থেকে মানব জাতি যেন রক্ষা পায়। করোনাভাইরাসে মৃত্যুবরণকারী সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে দেশের চরম দুঃসময়ে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা একে একে মৃত্যুবরণ করছেন। মনে হচ্ছে ইতিহাসের পাতা থেকে একটা একটা করে পাতা ঝড়ে পড়ছে। চরম এই দুঃসময়ে প্রশাসন থেকে শুরু করে সবাই একতাবদ্ধ হয়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। পুলিশ, র‌্যাব, আনসার ও ভিডিপি, সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, গণমাধ্যমকর্মীরা প্রতিনিয়ত এ দুঃসময়ে সাহসের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।  এদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তিনি বলেন, করোনার কারণে কেউ মারা গেলে আত্মীয়-স্বজনরা লাশ ফেলে চলে যায়। সেই লাশটা টানে পুলিশ বাহিনী। তারা কবর দিচ্ছেন, জানাজা পড়ছেন। ভয়ে আপনজন  কেউ থাকছে না। মানুষ ভয়ে ভীত হয়ে এরকম অমানবিক আচরণ করবে এটাও কিন্তু দুঃখজনক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে সবার কাজ করার সুযোগ ছিল না। যারা নিয়মিত চাকরির  বেতন পেতেন, তার বাইরে কিছু লোক থাকে যারা  ছোটখাটো কাজ করে খান। ব্যবসা করে খান। প্রতিটি মানুষের খবর নিয়ে তাদের ঘরে খাবার ব্যবস্থা করি। এমনকি রিকশার পিছনে যারা আর্ট করে এমনকি সাংস্কৃতিককর্মী তাদেরকে কিছু সরকারিভাবে, কিছু আমাদের ত্রাণ তহবিল থেকে সাহায্য সহযোগিতা করেছি। আর্টিস্ট বা শিল্পী কিংবা শিল্পীদের সহযোগিতার কথা  কেউ ভাবেন না। এই ভাবনাটা কিন্তু আমার নিজের না। সত্যিকারের কথা বলতে কি এটা শেখ রেহানার চিন্তা। সেই কিন্তু খুঁজে খুঁজে তাদের সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। করোনাভাইরাসের পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় আম্ফান মোকাবিলা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের সময়ে প্রায় ২৪ লাখ লোককে আমরা নিরাপদ জায়গা সরিয়ে নিয়েছিলাম। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে পারায় আম্ফান অনেক কিছুর ক্ষতি করতে পারলেও আমরা অনেক মানুষের জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি। করোনার দুঃসময়ে কষ্টে থাকা মানুষকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পৌঁছে দেওয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ছাড়াও অনেক বিত্তশালী সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে নিজেদের আত্মীয়ের লাশ ভয়ে ফেলে চলে গেছেন। পুলিশ ছাড়াও আমার ছাত্রলীগের ছেলেরা সেই লাশ দাফন করছেন।

 ভীত হয়ে আত্মীয়ের লাশ ফেলে যাওয়া- এটা একটা অমানবিক কাজ। আমার নির্দেশে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ছাড়াও কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগের ছেলেরা কৃষকের পাশে দাঁড়িয়ে ধান কেটে দিয়েছেন। ধান মাথায় নিয়ে কৃষকের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন।

চলতি সংসদের প্রয়াত সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর যাঁদেরকে সবসময় পাশে পেয়েছি, প্রয়াত সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লা তাঁদের একজন। অত্যন্ত ত্যাগী ও সাহসী নেতা ছিলেন। প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে প্রথম কাতারে থেকে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। একে একে অনেককেই আমরা হারিয়ে ফেলছি। কিন্তু বর্তমান এমন একটা পরিস্থিতি তাতে মৃত্যুর পর অনেক পরিচিতদের দেখতে পর্যন্ত যেতে পারছি না। অপর সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন অসুস্থ থেকেও এলাকার মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে সহায়তা দিয়েছেন। আমি মানা করার পরও শুনেননি। উল্টো বলেছেন, মানুষের কাছে না গেলে তাঁর ভালো লাগে না।

প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগম প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যখন অনার্সে পড়ি, তখন মাস্টার্সের ছাত্রী ছিলেন মমতাজ বেগম। একসঙ্গে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম, মিছিল করেছি। আমি বিরোধী দলের নেতা হলেও ওয়ান ইলেভেনে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। আমার বিরুদ্ধে বিএনপি ছাড়াও ওয়ান ইলেভেনের সময় অনেক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। আমাকে যখন আদালতে আনা-নেওয়া করা হয়, তখন মমতাজ বেগমকে দেখেছি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। সবসময় উনি আমার পাশে ছিলেন। প্রয়াত সংসদ সদস্য কামরুন নাহার পুতুল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা প্রতিবাদ করেছেন তাদের অনেককেই জিয়াউর রহমান হত্যা করেছে। সাবেক এমপি পুতুলের স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান পটল বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করায় তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

নিজের প্রিয় শিক্ষক ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রী বা যাই-ই হই না কেন, আনিসুজ্জামান স্যারকে  সবসময় নিজের শিক্ষক হিসেবেই সম্মান করতাম। তাঁর বয়স হয়েছিল। তাঁর চিকিৎসার সব ধরনের ব্যবস্থাও করেছিলাম। তিনি বলেন, এই দুঃসময়ে অনেক বিশিষ্টজনকে আমরা হারিয়েছি। কাকে ছেড়ে কার কথা বলব। প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী পদ্মা সেতু নির্মাণে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন, সবসময় খোঁজ-খবর রাখতেন। তাঁর অবদান সবাই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

আলোচনার শেষ পর্যায়ে সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নাসিম ও সাহারা খাতুনের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর