শিরোনাম
শুক্রবার, ১২ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

শিল্প বাঁচাতে প্রণোদনা আছে কর্মসংস্থানের কৌশল নেই

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল করোনাকালে যে বাজেট উপস্থাপন করেছেন, সেই বাজেটে অর্থনীতি চাঙ্গা করার প্রচেষ্টা রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে লকডাউনের প্রভাবে বিপর্যস্ত শিল্প খাত বাঁচাতে রয়েছে একগুচ্ছ প্রণোদনা আর কর সুবিধার প্রস্তাব। তবে স্মরণকালের এই মহাবিপর্যয়ে হঠাৎ করে দেশের যে মানুষগুলো কর্মসংস্থান হারিয়েছে, তাদের আয়ের সংস্থান তৈরির বিষয়ে নেই সুনির্দিষ্ট কৌশল।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অবশ্য বাজেট পুস্তিকায় উপস্থাপন করেছেন, দীর্ঘ সাধারণ ছুটি ও লকডাউনজনিত কারণে দরিদ্র কর্মজীবী মানুষের কষ্ট লাঘবে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা সম্প্রসারণ করার বিষয়টি তার সরকারের তৃতীয় অগ্রাধিকার। আর সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আংশিক বন্ধ থাকায় শিল্প উৎপাদন, এসএমই, সেবা খাত ও গ্রামীণ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মহীনতা এবং কর্মহীন হয়ে দেশে ফেরত আসা প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ব্যাপক কর্মসৃজন ও পল্লী উন্নয়ন হলো চতুর্থ অগ্রাধিকার। স্বাস্থ্য খাত প্রথম আর দ্বিতীয় কৃষি। তবে সামাজিক নিরাপত্তা খাত বাড়ানো, মানুষের হাতে কিছু নগদ টাকা তুলে দেওয়া আর ঘোষিত বাজেটে খাতভিত্তিক কিছু তহবিল বাড়ানোর মাধ্যমে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না, যে লোকটি এরই মধ্যে বেকার হয়ে গেছেন, তিনি কবে কাজ পাবেন? নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না, নতুন করে যে ২০ লাখ লোক শ্রমবাজারে ঢুকবে, অথবা সংকট দীর্ঘায়িত  হলে আরও যারা বেকার হবে তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে। সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে, এটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সামাজিক সুরক্ষা খাতের যে বরাদ্দ সেটির একটা বড় অংশ কিন্তু পেনশন-ভাতার দিকে যায়। প্রকৃত অর্থে বরাদ্দ কতটুকু বেড়েছে সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যে সংকট আমরা দেখছি, এ সংকটে একটা বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী কিন্তু দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে গেছে এবং সামনের দিনগুলোতে আরও বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে; বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী কাজ হারিয়েছে। সুতরাং এই জনগোষ্ঠীকে কীভাবে সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতায় আনা যায়, বিশেষ করে এখন যখন জোনিং করা হচ্ছে, কীভাবে তাদের খাদ্য ও নগদ সহায়তা দেওয়া যায় বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে বাজেটে সেটি নিশ্চিত করা উচিত ছিল। শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই চলবে না।  

শিল্প বাঁচাতে একগুচ্ছ প্রণোদনা : কভিড-১৯ দেশের শিল্প খাতে যে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি করেছে, সেটি মোকাবিলায় প্রস্তাবিত বাজেটে অবশ্য একগুচ্ছ প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। স্থানীয় উৎপাদনমুখী শিল্পে আমদানি পর্যায়ে কাঁচামালের ওপর আগাম কর ৫ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। অগ্রাধিকারমূলক ফাস্টট্র্যাক প্রকল্প, অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক, পিপিপি প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আগের মতোই ভ্যাট অব্যাহতি পাবে। একই সঙ্গে ভারী প্রকৌশল শিল্প এবং দেশীয় শিল্প বিকাশে অটোমোবাইল, রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ার কন্ডিশনারসহ কতিপয় শিল্পে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। দেশীয় এসএমই খাতকে সুবিধা দিতে পেরেক, স্ক্রু, ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ককর বাড়ানো হয়েছে। মৎস্য, পোলট্রি ও ডেইরি শিল্পে সুবিধা দিতে এসব খাতে খাদ্য আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নতুন করে আরও দুটি উপকরণ সয়াবিন অয়েল কেক ও সয়াবিন প্রোটিন কনসেনট্রেট আমদানিতে রেয়াতি সুবিধার প্রস্তাব রয়েছে। এ ছাড়া দেশীয় পোলট্রি শিল্পের সুরক্ষায় চিকেন ইন কাট পিস আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। তবে খাদ্য লবণের সুরক্ষা দিতে শিল্প লবণ সোডিয়াম সালফেট/ডাই সালফেট) আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত উৎপাদন পর্যায়ে ব্যয় বাড়াবে।

শতভাগ রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট ও টেক্সটাইল শিল্পে ব্যবহৃত আরএফআইডি ট্যাগ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেকিং সিস্টেম, কাটিং টেবিল ইত্যাদি আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। রপ্তানি বহুমুখীকরণে পাদুকা শিল্পের প্রসারে কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। দেশীয় জাহাজ শিল্পের বিকাশে ড্রেজার আমদানিতে শুল্ককর বাড়ানো হয়েছে। ইস্পাত শিল্পের বিকাশে ওই শিল্পের রি-ফ্যাক্টরি সিমেন্ট আমদানিতে শুল্ক হ্রাস এবং কাঁচামাল উৎপাদনকারী শিল্পের স্বার্থরক্ষায় ফেরো ম্যাঙ্গানিজ, ফেরো সিলিকন, ফেরো সিলি ম্যাঙ্গানিজ আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। প্লাস্টিক ও প্যাকেজিং শিল্পের বিকাশে ফটোগ্রাফিক প্লেটস অব প্লাস্টিক আমদানিতে শুল্ক কমানো হয়েছে। কাগজশিল্পের বিকাশে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ওয়াশিং অ্যান্ড ক্লিনিং এজেন্ট আমদানিতে শুল্ক কমানো হয়েছে। দেশীয় লুপ ব্র্যান্ডিং শিল্পের কাঁচামাল বেইজ অয়েলে শুল্কহার কমানো হয়েছে। দেশীয় সিআর কয়েল শিল্প সুরক্ষায় কয়েল আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার ও অটোট্যাংক শিল্পকে নতুন শিল্প হিসেবে প্রণোদনা দিতে রেয়াতি সুবিধার প্রস্তাব করা হয়েছে। সেলুলার ফোন উৎপাদন ও সংযোজন পর্যায়ে উৎসাহ দিতে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক হ্রাস ও সেলুলার ফোন আমদানির ক্ষেত্রে ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণের প্রস্তাব রয়েছে। এ ছাড়া গভীর সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণ তথা মৎস্য খাতকে সুবিধা দিতে ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালিং ইকুইপমেন্ট আমদানিতে শুল্ক কমানো হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে মোবাইল টেলিফোন সেট উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহতি এক বছর বাড়ানো হয়েছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সরিষা তেলের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণের লক্ষ্যে পাওয়ার টিলার, কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারসহ কতিপয় যন্ত্রে ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। দেশীয় বস্ত্র শিল্পের বিকাশে পলিস্টার রেয়ন ও অন্যান্য সিনেথেটিক সুতার ওপর ভ্যাট মূল্যভিত্তিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে কেজিপ্রতি সুনির্দিষ্ট করারোপ করা হয়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধেও উদ্যোগ রয়েছে নতুন বাজেটে। কভিড-১৯ এর জন্য ব্যবহৃত ওষুধ ও ওষুধসামগ্রী ছাড়াও পরীক্ষার কিট ও সুরক্ষা পোশাকের উৎপাদন, আমদানি ও ব্যবসায়ী পর্যায়ের ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। নিত্যপণ্য চাল, আটা, আলু পিয়াজ, রসুন স্থানীয়ভাবে সরবরাহের ক্ষেত্রে উৎসে আয়কর ৫ শতাংশের স্থলে ২ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত এমএস স্ক্রাপ সরবরাহে উৎসে আয়কর ৫ শতাংশ থেকে দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এতে ছোট কোম্পানি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সুবিধা পাবেন। পোলট্রি শিল্পে অগ্রিম আয়কর ৫ থেকে ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। রপ্তানি বাড়াতে তৈরি পোশাকসহ সব ধরনের পণ্য রপ্তানির ওপর উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। দেশীয় শিল্প রক্ষায় প্রস্তাবিত বাজেটে এতসব প্রণোদনার জন্য অর্থমন্ত্রী প্রশংসা পাবার যোগ্য। বাজেটে ঘোষিত এসব উদ্যোগ শিল্প খাতকে চাঙ্গা করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে শুধু শিল্প খাতের প্রণোদনা করোনা মহামারীতে উন্নয়নের পথ থেকে হঠাৎ লাইনচ্যুত দেশের আর্থ-সামাজিক খাতকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম কি-না সে প্রশ্নও তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত বছরের ঠিক এই মাসটিতে (১৩ জুন) ঘোষিত বাজেট পুস্তিকাটির শিরোনাম ছিল ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ-সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’। সেই পুস্তিকার পরতে পরতে ছিল সুখী, সমৃদ্ধ, কল্যাণমুখী ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে দিন বদলের সনদ রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে সরকারের সাফল্যের চিত্র। ছিল ক্ষুদ্র ও দারিদ্র্যমুক্ত ২০৩০ এর স্বপ্ন বাস্তবায়ন এবং তারই ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সালে জাতির পিতার আজীবন লালিত ‘সোনার বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস অর্থাৎ গত জানুয়ারি পর্যন্ত উন্নয়নের সেই পথেই ছিল দেশ। বিপুল বিক্রমে এগিয়ে চলছিল স্বপ্নের পদ্মা সেতু ও রাজধানীর মেট্রোরেলসহ মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ। রপ্তানি, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোতে ছিল ইতিবাচক চিত্র। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বরং প্রবৃদ্ধি কত বেশি হবে সেই হিসাব কষার তোড়জোড় চলছিল সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোতে। বাংলাদেশের উন্নতির সংবাদ ছাপা হচ্ছিল প্রভাবশালী বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে কীভাবে একটি স্বল্পোন্নত দেশ স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে ১৬ কোটি জনসংখ্যার চাপ নিয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সেটিই হয়ে উঠছিল অর্থনীতিবিদদের মৌলিক গবেষণার বিষয়। সহস্রাব্দের উন্নয়ন থেকে (এমডিজি) টেকসই উন্নয়নের (এসডিজি) দিকে এগিয়ে যাওয়া দেশটির অর্থনৈতিক মানচিত্রটাই পাল্টে দিয়েছে কভিড-১৯ নামক আনুবীক্ষণিক এক ভাইরাস। গত কয়েক দশক ধরে একটু একটু করে প্রবৃদ্ধি বাড়তে বাড়তে যেটিকে ৮ শতাংশের ওপরে নিয়ে আসা হয়েছিল, এক ধাক্কায় সেটিই এখন ১ থেকে দেড় শতাংশে নেমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর অল্প অল্প করে দারিদ্র্য হার কমিয়ে ২০১৯ সালে যেটিকে ২০ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়েছিল, সেটিই আবার বেড়ে ৩৫ থেকে ৩৬ শতাংশের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে বলে গবেষকরা জানাচ্ছেন। অর্থাৎ কভিড-১৯ নামে এক ভয়াবহ ভাইরাস বাংলাদেশের গতিময় যাত্রাপথে শুধু বাধাই সৃষ্টি করেনি, উন্নয়নের পথে ধাবমান গাড়িটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। সেই গাড়িটি এখন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে রাস্তার পাশে খাদে। যার নিচে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাওয়া মানুষের লাশ...। এই বাজেট কি সেই গাড়িটিকে আবার উন্নয়নের পথে টেনে তুলতে সক্ষম?-বিশেষজ্ঞদের এখন এটিই প্রশ্ন।

সর্বশেষ খবর