শনিবার, ১৩ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

মানুষকে বাঁচাতে বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট

বাজেটোত্তর অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল

নিজস্ব প্রতিবেদক

মানুষকে বাঁচাতে বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, সবার আগে আমাদের মানুষ বাঁচাতে হবে। মানুষকে খাবার দিতে হবে। চিকিৎসা দিতে হবে। এজন্য আমরা সবার সহযোগিতা চাই। এবার যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে মূলত মানুষ রক্ষা করাটাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। টাকা কোথা থেকে আসবে সেটা পরে দেখা যাবে। আগে আমরা ব্যয় করতে চাই। পরে আয় করব। কেননা এখন মানুষের জীবন রক্ষা করা আমাদের মূল উদ্দেশ্য। অর্থমন্ত্রী গতকাল ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট-উত্তর অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছিলেন। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে অনেক বেশি টাকা থাকতে হবে এমন নয়। এ বাজেট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ব্যাংকিং খাত কোনো ধরনের চাপে পড়বে না। এ বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা আমাদের আছে।

সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেন, এবারের বাজেট তৈরির ক্ষেত্রে অতীত অভিজ্ঞতা, সবার মতামত, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও অর্থনৈতিক চিন্তাবিদদের পরামর্শের ভিত্তিতে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি। এবার মহামারীর কারণে ভিন্ন পথে কাজ করতে হয়েছে। অসঙ্গতি মনে হতে পারে। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। করোনা মোকাবিলায় সরকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। এটি অব্যাহত থাকবে। আমাদের প্রধান কাজ এই দুর্দিনে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তাদের মুখে খাবার দেওয়া, তাদের কাজ দেওয়া। অন্য সময় আমরা আগে আয় করতাম, পরে খরচ করতাম। করোনা আমাদের সেই পুরনো সিস্টেম উল্টে দিয়েছে। করোনা মোকাবিলায় এখন আমরা আগে খরচ করব, পরে আয় করব। আমি আশা করি করোনার এই দুর্দিন বেশি সময় থাকবে না। তার পরও যদি করোনাকাল দীর্ঘ হয় সেক্ষেত্রেও আমাদের কাছে পথ খোলা রয়েছে। 

অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, এবারের বাজেট অতীতের অর্জনের ভিত্তিতে করা হয়েছে। ১০ বছর ধরে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়ে আসছে। মাথাপিছু আয় গত ৫ বছর ধরে সর্বোচ্চ। তিনি বলেন, আমরা আশা করি, এ বাজেট আমরা যেভাবে সাজিয়েছি, সেভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব। আমাদের প্রত্যাশা হলো করোনা বেশি দিন প্রলম্বিত হবে না। আইএমএফ বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করব। ইতিমধ্যে আমাদের ভৌত অবকাঠামো তৈরি করা আছে। সুতরাং আমরা বিশ্বাস করি, ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব। এজন্য বাজেটটি আমরা দিয়েছি।

এবার আমাদের হাতে কোনো ডাটা ছিল না। কোনো তথ্য-উপাত্ত ছিল না। বাজেট তৈরিতে আমাদের অভিজ্ঞতা আর অর্জনগুলোকে কাজে লাগাতে হয়েছে। এবারের বাজেট দেওয়া হয়েছে মানুষকে রক্ষার জন্য। মানুষকে খাবার দিতে হবে। চাকরি হারাদের চাকরি দিতে হবে, চিকিৎসা দিতে হবে। এবারের বাজেটে আমরা এসবই গুরুত্ব দিয়েছি। আপনারা দেখবেন স্বাস্থ্য এবং কৃষি এ দুটোকেই আমরা অধিক গুরুত্ব দিয়েছি। কেননা কৃষির কারণে সভ্যতা এগিয়েছে। আমরাও কৃষি সভ্যতার ওপর নির্ভর করে এগিয়ে যেতে চাই। করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যসেবার পরই গুরুত্ব পাবে কৃষি। সেটি আমাদের শেকড়। কৃষিকে এমনভাবে সাজাব যেন কৃষির ওপর নির্ভর করে অর্থনীতিকে আলোকিত করতে পারি। আরও অর্জন গভীর করতে পারি।

ভার্চুয়াল এই সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীকে সহায়তা করেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুুকদার ও এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনীম।

প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা রাজস্ব আদায়ের প্রতি জোর দিচ্ছি। আমাদের এখন রাজস্ব জিডিপি রেশিও মাত্র ১০ শতাংশ। এটাকে যদি অন্তত ১৫ শতাংশে নিতে পারি তাহলেও আমাদের জন্য বিরাট অর্জন হবে এবং আমরা সে চেষ্টাই করছি। আমাদের এখানে যারা কর দেয়, তারা দিয়েই যায় আর যারা দেয় তারা কখনই দেয় না। এটা ঠিক নয়। আমরা এমন অবস্থা থেকে বেরিয়ে করজাল বৃদ্ধি করতে চাচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা এখন এমন একটা অবস্থা তৈরি করতে চাই যেন কেউ বিদেশে বিনিয়োগ করতে না যায়, তারা এখানেই বিনিয়োগ করবেন। আবার বিদেশি বিনিয়োগও আসবে। আমরা এখন পথ চিনে গেছি কীভাবে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। এজন্য সব কিছু খুলে দেওয়া হচ্ছে। দেশি এবং বিদেশি কোম্পানি একই ধরনের পণ্য তৈরি করবে। আমরা সেটাকেও অনুমতি দিচ্ছি। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেক দেশের তুলনায় আমরা এখনো ভালো আছি। ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষ আমাদের থেকেও খারাপ অবস্থায় রয়েছে। সেখানে আমাদের চেয়েও গরিব মানুষ রয়েছে। কয়েকদিন আগেও একটা রিপোর্ট বেরিয়েছে বিদেশি কাগজে আমরা বিশ্বের নবম হেলথ ও ইকোনমির দেশ হতে যাচ্ছি। করোনা পরিস্থিতি হয়তো দ্রুতই কেটে যাবে। মনে হয় না এটা ততটা প্রলম্বিত হবে। আর যতি প্রলম্বিত হয়ও সেটার জন্য আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার বিপুল পরিমাণ ব্যাংক ঋণ নেবে এ সংক্রান্ত একক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ যখন অনেক বেশি ছিল তখন ব্যাংকে তারল্য সংকট ছিল। এখন কিন্তু সেই সংকট নেই। খেলাপি ঋণ কমে এসেছে। ফলে ব্যাংক খাত তেমন কোনো চাপে পড়বে না। 

দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যায়। এবারের বাজেটে পাচার রোধে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের আইনি দুর্বলতা রয়েছে। এ সংক্রান্ত তো কোনো আইনই নেই। আমাদের সেসব জায়গায় কাজ করতে হবে। আমাদের ধীরে ধীরে অটোমেশনের দিকে যেতে হবে। শতভাগ অটোমেশন করতে পারলে পাচার বন্ধ হয়ে যাবে। তবে এখন কিন্তু আগের তুলনায় পাচার অনেক কমেছে দাবি করে তিনি বলেন, আগে বলা হতো মাল এসেছে, পেমেন্ট হয়ে যেত কিন্তু মাল আসলে মাল আসত না। এখন কিন্তু সে পরিস্থিতি নেই। কোনো দেশের সরকারই চায় না তার দেশ থেকে পুঁজি পাচার হয়ে যাক। পাচাররোধ করতে হলে আমাদের আইনি প্রক্রিয়াগুলো আরা শক্তিশালী করতে হবে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, গত বছর আমাদের মূল্যস্ফীতি প্রজেকশন অনুযায়ীই ছিল। বিনিয়োগ জিডিপি অনুপাতে ছিল। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে প্রাক্কলন অনুযায়ী অর্জন করেছি। এবারের এই বাজেটও বাস্তবায়ন করতে পারব। আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘সত্তরের দশকে চাল উৎপাদন হতো ১০ লাখ টন। এখন ৫?গুণ বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শেকড়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ো। ৫ হাজার বছর আগে থেকে আমাদের সভ্যতা, এগিয়ে যাওয়া, যার মাধমে এগিয়েছি, সেটা হলো কৃষি। কৃষির হাত ধরেই টাইগ্রিস নদীর এপার-ওপার ধরে, নীল নদের এপার-ওপার ধরে আমরা এগিয়ে গিয়েছি। সভ্যতা এগিয়েছে। কারণ হলো কৃষি। করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যসেবার পরই?গুরুত্ব পাবে কৃষি। সেটা আমাদের শেকড়। কৃষিকে এমনভাবে সাজাব, যেন কৃষির ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতিকে আলোকিত করতে পারি, আরও অর্জন গভীর করতে পারি।

তিনি আরও বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে ব্যাংকিং খাত  দেখেছি। আমার আগে ব্যাংকের নন-পারফরমিং লোনের পরিমাণ  বেশি ছিল। সে কারণে ব্যাংকগুলো মাঝে মধ্যে লক্ষ্য করতাম, তাদের লিকুইডিটির অবস্থা একটু খারাপ হয়ে যেত। ইদানীং কোনো ব্যাংকের লিকুইডিটি খারাপ, এ কথা শুনিনি। এখন কেউ বলতে পারবে না, ব্যাংকে গিয়ে টাকা পাইনি, ফিরে আসছে। কোনোরকম খারাপ ব্যবহার করেছে গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এটা আমার সময় পাইনি। এ সফলতা তুলে ধরে প্রশ্নকারী সাংবাদিককে ‘দুই বছর আগে আর দুই বছর পরে’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখারও অনুরোধ জানান অর্থমন্ত্রী।

আরেক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনীম বলেছেন, বর্তমানে কলরেট অনেক কম তাই অপ্রয়োজনীয় কথা বলার প্রবণতা বেড়ে গেছে। তবে কথা বলার প্রবণতা কমানোর জন্য কলরেটে আরও ৫ শতাংশ শুল্ক বসানো হয়নি। বরং কলরেট কম তাই মাত্র ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে, যা ব্যয়ের সক্ষমতা মানুষের আছে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে ড. মসিউর রহমান বলেন, স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়। দুর্নীতি বন্ধ করার কর্তব্য সরকারের। এজন্য তিনি ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়ার অনুরোধ করেন। আরেক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, আবগারি শুল্ক নিচের দিকে কিছু করা হয়নি। ১০ লাখ টাকার ওপরে করা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ানোর ব্যাপারে অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, খরচের সক্ষমতা নেই। এ ছাড়া অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকা রাখা আছে। প্রয়োজনের সময় তা খরচ করা হবে। তিনি বলেন, প্রতি বছর হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করতে পারে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আরেক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ কোনো দেশের সরকারের দায়িত্ব নয়। সরকার চায় বাজারটি এমনভাবে চলবে যাতে অর্থনীতি শক্তিশালী হয়। আমরা যদি অর্থনীতিকে সবার ওপরে নিতে চাই তাহলে শেয়ারবাজারে এর প্রভাব এমনিতেই পড়বে। আরেক প্রশ্নের জবাবে এম এ মান্নান বলেন, এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ দুটি মন্ত্রণালয়ের যে কোনো প্রকল্প আসলে বিলম্ব না করেই চূড়ান্ত করা হবে। উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর