শনিবার, ১৩ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

রাজস্ব আয়ের কঠিন চাপ ব্যবসা সচলের আশা

ব্যবসা-বাণিজ্য সচল হলেই রাজস্ব আয়ের কঠিন চাপ সামলানো যাবে

রুহুল আমিন রাসেল

করোনাকালের বাজেটে রাজস্ব আয়ে কঠিন চাপ পড়ছে। আগামী অর্থবছরে এই চাপ সামলাতে হবে করদাতা থেকে শুরু করে রাজস্ব প্রশাসনকে। কারণ মহামারী করোনাভাইরাসে জনমনে আতঙ্ক চলছে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থমকে যাওয়ায় আমদানি-রপ্তানিতেও স্থবিরতা চলছে। আছে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের ছোবল। ফলে অর্থনীতির সব হিসাব এখন এলোমেলো। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য সচলের আশা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সচল হলেই রাজস্ব আয়ের কঠিন চাপ সামলানো যাবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও স্থানীয় শিল্প-কারখানা বন্ধ। এসব শিল্প-কারখানা থেকে যে কর আদায় হওয়ার কথা, তা আর হবে না। অনেক কমে যাবে। এই পরিস্থিতি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের কোনো সুযোগ নেই। রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে যে সংকট আছে, সেটা বাজেটে প্রতিফলন হয়নি। খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, আগামীতে আয়কর, অগ্রীম কর, শুল্ক কর আদায় অনেক কমে যাবে। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কোনোভাবেই অর্জন হবে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, রাজস্ব আয়ের এই টার্গেট করদাতা ও এনবিআর কর্মকর্তাদের ওপর কঠিন চাপ হয়ে দাঁড়াবে। তবে প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়নের ফলে সারা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সচলের আশা করা যায়। কিন্তু বাস্তবচিত্র হলো-এখন ব্যবসা-বাণিজ্য সচল নেই। প্রণোদনা প্যাকেজেও দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে। এক কথায় বলা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্য সচল হলে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট পূরণ হবে। এজন্য আমদানি ও রপ্তানি বেশি থাকতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান বাস্তবতায় চলতি ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হবে বড় জোর দুই লাখ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আদায় কম হওয়ায় বাজেট ঘাটতি বেড়েছে। আর তা পূরণের জন্য সরকারকে ঋণ করতে হবে বেশি। প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, চাহিদা, সরবরাহ, আয় ইত্যাদির নিরিখে এ বছর ভালো যাবে না। এ অবস্থায় প্রস্তাবিত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে নিম্নমুখী অর্থনৈতিক পরিবেশে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা যথাযথ হয়নি। বাজেটে শুল্ক ও কর বিষয়ে জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলে বাজেট আরও কল্যাণকর হবে।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, রাজস্বের ওপর প্রচ- চাপ পড়বে। ব্যবসা না হলে ব্যবসায়ীরা রাজস্ব দেবেন কোথা থেকে? আমদানি-রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তারমতে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে কঠিন চাপে পড়বেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। ব্যাংক থেকে ঋণের বিকল্প ভাবতে হবে এখনই। তবে বাজেটে বেশ কিছুটা ভালো পদক্ষেপও দেখছেন এই ব্যবসায়ী নেতা। বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমানের মতে, হিসাব মেলানোর জন্য রাজস্ব আদায়ে এনবিআরকে একটি অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক, মানবিক এবং অর্থনীতি খাতে যে ঝুঁকি দেখা দিয়েছে, বাজেটে তা মোকাবিলায় সে ধরনের কোনো সামাজিক কাঠামো নেই। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকিং কমিশন গঠন, দুদককে শক্তিশালী করা, ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, প্রবাসী ও সরকারি কর্মচারী এবং শস্য ও গবাদিপশু বীমার কথা বলা হয়েছিল।

এনবিআরের সাবেক জ্যেষ্ঠ সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিনের মতে, প্রস্তাবিত বাজেটে শুল্ক ও কর বিষয়ে সাধারণ মানুষের উল্লিখিত প্রত্যাশা তেমন প্রতিফলন হয়নি। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাও বাস্তবসম্মত না। প্রান্তিক, ক্রমাগত দারিদ্র্যে পর্যবসিত জনগোষ্ঠী, কর্ম ও আয়হারা বা নিম্নআয়ের মানুষের স্বার্থে আমদানি অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্যের শুল্ক ও কর হ্রাস করা হলে ভালো হতো। বাজেটে এ সংক্রান্ত কোনো ঘোষণা নেই। করের বোঝা যত কম হবে তা তত ভোক্তা ও ব্যবসায়ীবান্ধব হবে। করহার বেশি হলে ব্যবসায়ীরা তা ফাঁকি দেবেন বা এড়িয়ে যাবেন। বাংলাদেশে আমদানি, স্থানীয় পর্যায়ে ও আয়কর এবং করপোরেট করে শুল্ক ও করহার বেশি। ফলে কর ফাঁকিও বেশি হয়, যা জিডিপির প্রায় ৭-৮ শতাংশ। এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেই বাজেটে।

ব্যবসায়ীদের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিজনেস ইনশিয়াটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট-বিল্ড বলেছে, ঘোষিত বাজেটে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেশি। এটা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৯ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এ লক্ষমাত্রা কিছুটা উচ্চাভিলাষী। ব্যবসায় পরিচালনার (ডুয়িং বিজনেস) জটিলতা অবশ্যই কমিয়ে আনতে হবে। এক্ষেত্রে এনবিআর অটোমেশনের যে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে, তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। বর্তমানে অনলাইন কার্যক্রম সর্বত্র জনপ্রিয় হচ্ছে, জনসাধারণও এতে অভ্যস্ত হচ্ছে। ডেটা ফ্লোরের জন্য নীতিমালা, ডেটা লোকালাইজেশনের শর্তাবলী, অনলাইন প্লাটফর্ম এবং অ্যাপভিত্তিক কার্যক্রম চালু করতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন উন্বেষণ বলেছে, ব্যাংকিং খাত থেকে অভ্যন্তরীণ ঋণ বেড়েছে। আগেই তারল্য সংকটে থাকা ব্যাকিং খাতের অবস্থা আরও নাজুক হবে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কর ফাঁকি, কর জালিয়াতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। ট্রান্সফার প্রাসিং সেলের অকার্যকারিতার কারণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো থেকে অনেক কর আদায় সম্ভব হচ্ছে না। দেশে কর্মরত বিদেশি শ্রমিকদের কাছ থেকেও অনেক কর আদায় করা যেত। এগুলো না করে ইন্টারনেট, মোবাইল রিচার্জ, অনলাইন কেনাকাটার ওপর ঢালাও হারে করারোপ করায় স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। সংস্থাটি বলেছে, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে কেবল তিন হাজার ৯৪০ কোটি টাকা বরাদ্দের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এসএমই এবং উদ্যোক্তাদের সহায়তা করা খুব বাধা হয়ে দাঁড়াবে। পর্যাপ্ত ঋণ সুবিধা দেওয়া সম্ভব হবে না। উৎপাদন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে পড়ায় পুরো সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগ বন্ধ হয়েছে। প্রায় ২৮ শতাংশের আয় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ব্যাংকগুলোর আরোপিত কঠিন শর্তের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি স্তরের উদ্যোক্তারা ঋণে সহজ প্রবেশাধিকার পাচ্ছেন না।

উন্নয়ন উন্বেষণ বলেছে, সেবা খাত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বন্ধ হয়ে গেছে। নির্মাণশিল্প, পরিবহন, পর্যটন, হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদির কার্যক্রম বন্ধ থাকায় অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, পর্যটন এবং আতিথেয়তা শিল্পে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে নিযুক্ত অর্ধ মিলিয়ন মানুষ তাদের চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। মহামারীজনিত কারণে এ খাতে প্রায় পাঁচ হাজার ৭০০ কোটি টাকা লোকসানের অনুমান করা হয়েছে। লকডাউনের কারণে পরিবহন খাতে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ব্যাংক বীমা করোনার আগেই ধুঁকছিল। এখন সরকার অর্থ নিলে আরও একবার তারল্য সংকটে পড়বে। বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়বে। সেবা খাতের পুনরুদ্ধারের বিষয়টি বাজেটে উপেক্ষিত থেকে গেছে। জনসেবা, পরিবহন ও যোগাযোগ ইত্যাদি সেবা খাতে আগের তুলনায় বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে।

সর্বশেষ খবর