রবিবার, ১৪ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

অকুতোভয় এক সহযোদ্ধার প্রতি

তোফায়েল আহমেদ

দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা মোহাম্মদ নাসিমের অকাল মৃত্যু আমার জন্য তো বটেই, পরিবারের সদস্যবৃন্দ, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী  ও দেশবাসীর জন্য গভীর বেদনাদায়ক।  জগতে কেউ-ই চিরস্থায়ী নয়। আমাদেরও একদিন চলে যেতে হবে। তবু যে নেতা দেশ ও দশের অতি আপনজন, নীতির প্রশ্নে আপসহীন, জনকল্যাণে নিবেদিত, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অবিচল, তার এমন চিরবিদায় অপ্রত্যাশিত-অনাকাক্সিক্ষত। এই দুর্যোগকালে দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে তার সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে দু-চার কথা লিখতে হবে এমনটা কখনো  ভাবিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আমরা সবাই তার চিকিৎসা-সংক্রান্ত খোঁজ-খবর রাখছিলাম। রক্তচাপজনিত সমস্যা নিয়ে ১ জুন তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই দিনই এক পরীক্ষায় প্রথমে জানা যায় তার কভিড-১৯ পজিটিভ। কয়েক দিন পর, চিকিৎসা চলাকালে ইন্ট্রাসেরিব্রাল রক্তক্ষরণ হয়। ৪ জুন অবস্থার উন্নতি হয়। আমরা আশাবাদী হই। কিন্তু ৫ জুন ভোরে বড় ধরনের স্ট্রোক হয়। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত সমস্যার কারণে দ্রুত অস্ত্রোপচার করে আইসিইউতে রাখা হয়। তার চিকিৎসায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন ৭ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠিত হয়। এরপর ২ দফায় ৭২ ঘণ্টার নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। এরই মধ্যে পরপর তিনবার নমুনা পরীক্ষা করে দেখা যায় কভিড-১৯ নেগেটিভ। আমরা সবাই আশায় বুক বাঁধি। ১২ জুন কয়েক দিন স্থিতিশীল থাকার পর পুনরায় অবস্থার অবনতি ঘটে এবং শেষে ১৩ জুন বেলা ১১টা ১০ মিনিটে আমাদের সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ’৭৫-উত্তর স্বৈরশাসনের কবল থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মুক্তিসংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ মোহাম্মদ নাসিম ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর উপজেলায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জাতীয় নেতা শহীদ ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী এবং মাতা আমেনা মনসুর। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, প্রথম বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী এবং স্বাধীন বাংলাদেশের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। মোহাম্মদ নাসিম রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। রাজনৈতিক আবহে বেড়ে উঠেছেন, সারা জীবন সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক শাসক তাকেও গ্রেফতার করে, কারাদন্ডে দন্ডিত করে সাজা দিয়েছে। ষাটের দশক থেকেই রাজনীতির সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত থেকে স্বৈরশাসন বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে অকুতোভয় মোহাম্মদ নাসিম সব সময় সম্মুখ সারিতে ছিলেন। ’৬৯-এর গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থানে তিনি ছিলেন বৃহত্তর পাবনা অঞ্চলের অন্যতম সংগঠক। ছাত্রজীবনে মেধাবী মোহাম্মদ নাসিম পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে ষাটের দশকে ছাত্র রাজনীতি শুরু করলেও পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ছাত্রলীগে যোগদান করেন। ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি মুজিবনগরে ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৫-এ বাকশাল গঠনের পর বঙ্গবন্ধু আমাকে জাতীয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করেন। মোহাম্মদ নাসিম সে-সময় যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ’৮১ তে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে তিনি যুব সম্পাদক ও পরে ’৮৭-এর কাউন্সিলে প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার আগের বছর, ৮৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সিরাজগঞ্জ থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ’৭৮ থেকে ’৯২ পর্যন্ত আমি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। আমার পরে, ’৯২ ও ’৯৭-এর জাতীয় সম্মেলনে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে (তখন একজন সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল) মোহাম্মদ নাসিম নির্বাচিত হন। ২০০২ ও ২০০৮-এ অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তাকে কার্যনির্বাহী কমিটির এক নম্বর সদস্য পদে রাখা হয়। ২০১২-এর কাউন্সিলে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। পরপর তিন মেয়াদে তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে তিনি সিরাজগঞ্জ থেকে পরপর ছয়বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। একটানা বিজয়ের এই নির্বাচনী ফলাফল থেকে অনুমেয় যে, তিনি গণমানুষের কতটা কাছের মানুষ ছিলেন।  ’৯১-এ জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ’৯৬ তে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনার জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে প্রথমে ছিলেন ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে; পরে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। সে সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে উগ্র সংঠনের বিপথগামীদের সামাজিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে একই বছরের ১২ জানুয়ারি তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। রাজনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে মোহাম্মদ নাসিমকে অনেকবার কারাবন্দী হতে হয়েছে।  কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় প্রথম তাকে কারাগারে যেতে হয় ১৯৬৬ সালে। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ভুট্টা খাওয়ানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে পাবনা অঞ্চলে ‘ভুট্টা আন্দোলন’ সংগঠিত করলে পিতা এম. মনসুর আলীর সঙ্গে কারারুদ্ধ হন। এক বছর পর মুক্তি পান। ’৭৫-এ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকান্ডের পর গ্রেফতার করা হয়। ২০০৭-এর ফেব্রুয়ারি মাসে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাকে গ্রেফতার করে এবং মামলা দিয়ে কাশিমপুর কারাগারে আটক রেখে মানসিক নির্যাতন চালায়। যার ফলে তিনি অসুস্থ হন এবং চলতে-ফিরতে অসুবিধা বোধ করতেন। ২০০৮-এর জাতীয় নির্বাচনে তখন অংশ নিতে পারেননি। সেই আসনে তার সুযোগ্য সন্তান তানভীর শাকিল জয় অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। কর্মীবান্ধব-সংগঠক ও নেতা, বন্ধুবৎসল এবং অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী মোহাম্মদ নাসিম সাংবাদিক মহলসহ দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। আমরা যারা বয়োজ্যেষ্ঠ, তাদের প্রতি আচরণ তার এতটাই বিনম্র ছিল যে, বিস্মিত হতে হতো! পারিবারিক জীবনে মোহাম্মদ নাসিম ও তার স্ত্রী লায়লা আরজুমান্দ তিন সন্তানের জনক-জননী। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী মোহাম্মদ নাসিম রাজনীতিতে ও জাতীয় সংসদে তাদের পরিবারের ভূমিকা নিয়ে ‘সংসদে তিন প্রজন্ম’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছেন। ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন সামনের সারির নেতা। বহুবার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্মম হিংস্রতার ও অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তিনি। ২০০৪-এর একুশে আগস্ট শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে হত্যার উদ্দেশে পরিচালিত নারকীয় গ্রেনেড হামলায় তিনি গুরুতর আহত হন। আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি, কোনো দিন অন্যায়ের কাছে নতিস্বীকার করেননি। জাতির জনক ও পিতা মনসুর আলীর আদর্শে জীবন অতিবাহিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত শোকবার্তায় যথার্থই বলেছেন যে, ‘বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাকে হারিয়েছি।’ রাজনৈতিক অঙ্গনে সব দলের নেতা-কর্মীদের অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক। তার এই অকাল মৃত্যুতে ব্যক্তিগতভাবে আমি হারিয়েছি আমার পরম ¯ন্ডেœহভাজন অকুতোভয় প্রিয় সহযোদ্ধাকে, আর প্রিয় দেশবাসী হারিয়েছেন তাদের কাছের মানুষ প্রিয় নেতা ও সংগঠককে। মোহাম্মদ নাসিমের এই অকাল প্রস্থান অপূরণীয়। তার সংগ্রামী জীবনের প্রতি সশ্রদ্ধ স্মরণ রেখে পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা- তার আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক!

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

[email protected]  

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর