মঙ্গলবার, ১৬ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

যত বৈষম্য সিমেন্ট শিল্পে

অগ্রিম আয়কর ৩ শতাংশ, কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে টনপ্রতি ৫০০ টাকা ট্যাক্স অব্যাহত, কংক্রিটস আমদানি শুল্ক ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ, ফেরতযোগ্য করের টাকা আটকে থাকে বছরের পর বছর, হুমকিতে ৪২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

যত বৈষম্য সিমেন্ট শিল্পে

করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত দেশের সিমেন্ট শিল্পের জন্য যখন প্রয়োজন ছিল বড় ধরনের কর প্রণোদনা, তখন এই খাতটি আরও বৈষম্যের মুখে পড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে প্রায় ১৪ শতাংশ হারে টনপ্রতি ৫০০ টাকা শুল্ককর অব্যাহত রাখা হয়েছে।

শুধু তাই নয়, সিমেন্টের মানোন্নয়নে ব্যবহৃত প্রিপেয়ার্ড এডিটিভস ফর সিমেন্টস, মর্টারস অর কংক্রিটস (এইচএস কোড : ৩৮২৪.৪০.০০) আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্ক ছিল, তা না কমিয়ে উল্টো প্রস্তাবিত বাজেটে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। একে চরম বৈষম্যমূলক বলে তা আগের মতো ৫ শতাংশ রাখার দাবি জানিয়েছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। এ ছাড়া ফ্লাই অ্যাশ আমদানিতে আরোপিত রেগুলেটরি ডিউটি ৫ শতাংশ বহাল রয়েছে। এই শুল্ক বাতিলের দাবি জানিয়ে উদ্যোক্তারা বলছেন, এটি অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল হওয়ায় প্রত্যাহার করা উচিত।

অন্যদিকে সিমেন্ট শিল্পের জন্য কেবলমাত্র অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে, যা পুরোটা প্রত্যাহারের দাবি ছিল এই শিল্প খাত সংশ্লিষ্টদের।

এ ধরনের বৈষম্যমূলক করারোপের বিষয়টি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খোদ শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, করোনার কারণে আমাদের দেশীয় সিমেন্ট শিল্পগুলোর মতো শিল্পকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কর প্রণোদনা দেওয়া উচিত ছিল। কারণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হলে আমাদের নির্মাণ খাতকে উজ্জীবিত করতে হবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান ধরে রাখার জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রচুর উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। আর এসব উন্নয়ন কার্যক্রমের অন্যতম প্রধান উপকরণ সিমেন্ট। তাই দেশীয় সিমেন্ট শিল্পের অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারসহ অন্যান্য শুল্ক কমানো উচিত বলে জানান তিনি। সিমেন্ট শিল্পের কর বৈষম্যের বিষয়টি শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে তুলে ধরবেন বলেও জানান মন্ত্রী। সংশ্লিষ্টরা জানান, সম্ভাবনাময় এই খাতটি যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ‘রূপকল্প-২০২১’ এর উন্নয়ন প্রেক্ষিতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল; পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ দেশের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সিমেন্টের চাহিদা মেটানোর পরও অতিরিক্ত সিমেন্ট বিদেশে রপ্তানি করে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছিল, তখন ভয়াবহ করোনা মহামারী দেশের সিমেন্ট শিল্পে শুধু সংকট সৃষ্টি করেনি, পাশাপাশি এই শিল্পে ৪২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। ঝুঁকিতে পড়েছে এই শিল্পে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান।

সিমেন্ট শিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, করোনাকালে নতুন বাজেটে প্রস্তাবিত করহার যেন সিমেন্ট শিল্পের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। এমনিতেই করোনা মহামারীর কারণে দেশের সিমেন্ট শিল্পে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ড বন্ধ। এ অবস্থা কতদিন চলমান থাকে সে সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত নয়। এ ধরনের বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে যখন নতুন বাজেটে আরও বেশি কর সুবিধার প্রয়োজন ছিল তখন সেখানে উল্টো আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। তারা বলছেন, অগ্রিম আয়কর যেটি হয়েছে, সেটি আসলে সুবিধা নয়; বরং শাস্তি বা জরিমানার হার কিছুটা কমানো হয়েছে বলা যায়। আগে জরিমানা হিসেবে অগ্রিম আয়কর দিতে হতো ৫ শতাংশ হারে, এখন সেটি ৩ শতাংশ দিতে হবে। অর্থাৎ আগে যেখানে ‘মাথায় বাড়ি’ দেওয়া হতো, এখন সেখানে ‘চপেটাঘাত’ করা হবে। শাস্তিটা কিন্তু বহালই থাকল। শুধু তাই নয়, অগ্রিম আয়কর ফেরতযোগ্য হলেও তা আটকে থাকে বছরের পর বছর। সিমেন্ট শিল্পকে বাঁচাতে এই অগ্রিম আয়কর পুরোটাই অযৌক্তিক, এটা প্রত্যাহার করা উচিত। কমানো উচিত ক্লিংকার আমদানিতে ট্যাক্স।

ক্লিংকার আমদানিতে শুল্কারোপকে অযৌক্তিক বলে আখ্যায়িত করে সিমেন্ট শিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে শুল্ক টনপ্রতি ৫০০ টাকা আরোপ করা আছে যেটা কোনোভাবেই অন্য কোনো দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেহেতু প্রতি টন ক্লিংকার বর্তমানে ৪২ ডলার হিসাবে আমদানি করা হয়ে থাকে, সে হিসাবে এই ৫০০ টাকা আমদানি শুল্ক শতাংশের হিসাবে ১৪ শতাংশ হয় যা অযৌক্তিক। তারা বলছেন, এটা ৫ শতাংশ নামিয়ে আনা অথবা প্রতি টন ৩০০ টাকায় নির্ধারণ করা উচিত। অগ্রিম আয়কর নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথমে চলতি অর্থবছরের অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে এই অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয় এবং তা অসমন্বয়যোগ্য বলে চূড়ান্ত দায় হিসাবে বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে অগ্রিম আয়কর চূড়ান্ত দায় হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। অর্থাৎ কোনো কোম্পানি মুনাফা করুক বা লোকসান করুক তাকে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর দিতেই হবে। উদ্যোক্তারা চান এই অযৌক্তিক অগ্রিম আয়কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হোক। নিদেনপক্ষে এটি সমন্বয়যোগ্য কর হিসাবে ঘোষণা করা হোক।

অগ্রিম আয়কর কেন সমন্বয়যোগ্য কর হিসেবে ঘোষণার দাবি জানানো হচ্ছে, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত সব সিমেন্ট কোম্পানির সম্মিলিতভাবে ৭৫০ কোটি টাকারও বেশি অসমন্বিত অগ্রিম আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে আছে। যদি ১০ শতাংশ হারে সুদ বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে সিমেন্ট খাতটি শুধু সুদ হিসাবে প্রতি বছর ৭৫ কোটি টাকা হারাচ্ছে।

বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ)  প্রেসিডেন্ট ও ক্রাউন সিমেন্ট গ্রুপের ভাইস-চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ১৪৬ নং সেকশন অনুযায়ী, করদাতার পরিশোধিত টাকা পরিশোধযোগ্য করের চেয়ে বেশি হলে তা ফেরত পাওয়ার যোগ্য।  ফেরত দিতে দেরি হলে সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত না তা ফেরত দেবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার ওপর ৭.৫ শতাংশ হারে সুদ প্রদান করবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ ফেরতযোগ্য টাকাগুলো বছরের পর বছর পড়ে থাকে এবং বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও তা নগদে ফেরত পাওয়া যায় না। অথচ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এবং অ-তালিকাভুক্ত সব সিমেন্ট কোম্পানিই সরকারের নির্ধারিত অডিটর প্যানেলভুক্ত নিরীক্ষা ফার্মের মাধ্যমেই অগ্রিম আয়করের বিষয়টি নিরীক্ষা করে থাকে। তারপরও কেন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে এরকম করা হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। কিন্তু এই টাকাগুলো ছাড় করা গেলে অর্থাভাবগ্রস্ত সিমেন্ট কোম্পানিগুলো কিছু নগদ অর্থের সরবরাহ পাবে এবং এই কঠিন পরিস্থিতিতে অর্থায়নের খরচ কিছুটা কমিয়ে আনতে পারবে।

করোনা মহামারীজনিত বিপর্যয় : সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিমেন্ট খাতে করোনার প্রভাব ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। সরকারঘোষিত লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সিমেন্ট কারখানাগুলোতে ৯০ ভাগ উৎপাদন বন্ধ ছিল যেটা এখন ৬০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অথচ শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা চালিয়ে যেতে হচ্ছে। পাশাপাপাশি, অন্যান্য নিয়মিত খরচও প্রতিনিয়ত চালিয়ে যেতে হচ্ছে। অর্থাৎ পরিচালন খরচ কমেনি। অথচ দেশের সিমেন্ট শিল্প থেকে বছরে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব যায় সরকারের কোষাগারে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং অবকাঠামো খাতে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর ভিত্তি করে সিমেন্ট খাতে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি হয়ে আসছিল। কিন্তু ওই বছর থেকেই-এ প্রবৃদ্ধি নেমে আসে ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশে। এর অন্যতম কারণ ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া, অসমন্বয়যোগ্য অগ্রিম আয়কর, তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে সিমেন্টের নিম্নমুখী দামের প্রবণতা এবং নদীপথে ও সড়কপথে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া। এর ফলে প্রায় সবগুলো সিমেন্ট কোম্পানিকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এরকম একটি পরিস্থিতিতে সিমেন্ট খাত যখন ২০২০ সালের শুরুতে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল ঠিক তখনই অনাকাক্সিক্ষতভাবে আঘাত হানে করোনা মহামারী (কভিড-১৯), যার প্রভাব সিমেন্ট খাতসহ সব খাতেই দেখা যাচ্ছে। আলমগীর কবির জানান, এখনো পর্যন্ত অনুমান করা যাচ্ছে না করোনা মহামারীর এই অবস্থা কতদিন চলবে। যদি খুচরা বাজার মূল্য অনুযায়ী হিসাব করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে বাংলাদেশে করোনা শনাক্তের পর থেকে এ পর্যন্ত সিমেন্ট খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। ফলে সিমেন্ট খাতে যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করতে কত সময় লাগবে তা এখনো অনুমানের বাইরে। শুধু তাই নয়, করোনাকালীন পরিস্থিতির উন্নতি হলেও দেশের অর্থনীতিতে পূর্ণগতি না আসা পর্যন্ত সিমেন্ট শিল্পের সংকট কাটবে না। কারণ, এই খাতটির সঙ্গে নগরায়ণ, গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা ও নির্মাণ খাতকে উজ্জীবিত করার বিষয়গুলো জড়িত। এ অবস্থায় সরকারের কর প্রণোদনা ছাড়া দেশের সম্ভাবনাময় সিমেন্ট শিল্পকে টিকিয়ে রাখা যাবে না বলে আশঙ্কা বিসিএমএ’র প্রেসিডেন্টের।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর