বুধবার, ১৭ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

টেস্টের বহুমুখী বাণিজ্য

টাকার বিনিময়ে সিরিয়াল । বেসরকারির উচ্চমূল্য । সার্টিফিকেট বিক্রি

জুলকার নাইন

টেস্টের বহুমুখী বাণিজ্য

নরসিংদী থেকে আসা শিমুল বিশ্বাস কয়েকদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অসুস্থতা বাড়লে তিনি বেঞ্চে শুয়ে পড়েন -রোহেত রাজীত

শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে তিন দিন অপেক্ষা করেও টেস্ট করাতে ব্যর্থ হন মিরপুর এলাকার সিএনজিচালক সোবহান। তার মধ্যে উপসর্গ দেখা দেওয়ার দুই দিন পর স্ত্রীর মধ্যেও উপসর্গ দেখা যায়। পরে বাধ্য হয়ে হাসপাতালের গেটে পরিচয় হওয়া এক দালালের শরণাপন্ন হন সোবহান। রফিক নামের ওই দালাল আগের দিন সন্ধ্যায় তিন হাজার টাকা নিয়ে পরের দিন স্বামী-স্ত্রীর পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দেন। টেস্ট করার পাঁচ দিন পরও রেজাল্ট না আসায় সোবহান আবার শরণাপন্ন হন দালাল রফিকের। পরে ৫০০ টাকা বিকাশে দেওয়ার পর সোবহান তার রেজাল্ট হাতে পান।

এই ধরনের দালাল চক্র সক্রিয় আছে মুগদা জেনারেল হাসপাতালের সামনেও। মাঝে কয়েকদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারণে বন্ধ থাকলেও এখন আবার সেই চক্র সক্রিয়। এখানে টেস্ট করতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের। দালালদের কারণে সিরিয়াল পাওয়াই দায়। আশপাশের চা দোকানদার, ডাব বিক্রেতা ও হাসপাতালের আশপাশের মানুষজন সবার আগে এসে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থাকে বা ইট, পাথর দিয়ে সিরিয়াল দখল করে রাখে। ফলে বাইরের কেউ এলে সিরিয়ালগুলো কিনতে হয় তাদের কাছ থেকে। ৫০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় এসব সিরিয়াল। এক প্রকার বাধ্য হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও না পেয়ে কিনতে হয় এসব সিরিয়াল। আবার মোহাম্মদপুরের ব্র্যাকের একটি সেন্টারে দীর্ঘ অপেক্ষার পর টেস্ট করানো ব্যাংক কর্মকর্তা সাজিদ ৭ দিনেও পাননি রেজাল্ট। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে গত সোমবার সকালে তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে টেস্ট করান। সেখানে তাকে অপেক্ষা করতে হয়নি। একই দিন সোমবার সন্ধ্যায় জানতে পারেন তার রেজাল্ট। কিন্তু ধানমন্ডির এই হাসপাতালে সাজিদকে দিতে হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার টাকা। অথচ স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া তালিকায় বেসরকারি এই হাসপাতালে তিন হাজার টাকায় টেস্ট করানোর কথা ছিল। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলো আদায় করছে সাড়ে তিন হাজার থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই টেস্ট নিয়ে শুরু হয়েছে এই ধরনের নানামুখী বাণিজ্য। সরকারিভাবে বিভিন্ন হাসপাতালে ফ্রি টেস্টের যে আয়োজন করা হয়েছে তা নিয়ে আছে বিস্তর হয়রানির অভিযোগ। এই ভোগান্তির সুযোগে এসব টেস্ট করানোর জন্য অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে দালাল চক্র। অন্যদিকে বেসরকারিভাবে বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা টেস্টের জন্য ইচ্ছামতো মূল্য হাঁকানো হচ্ছে। সরকার নির্ধারিত মূল্য বেঁধে দেওয়া হলেও প্রতিটি বেসরকারি সংস্থাই নিচ্ছে উচ্চমূল্য। এর পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে করোনার নেগেটিভ সার্টিফিকেট বিক্রি। এসব ভুয়া নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও যাচ্ছেন অনেকে। বিদেশে গিয়ে ধরা পড়ছে সার্টিফিকেট ছিল ভুয়া। ফলে দেশের করোনা টেস্টের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এসব দেশ।জানা যায়, এপ্রিল মাসে তিন-চারটি চার্টার্ড ফ্লাইটে আটকে পড়া বাংলাদেশিরা জাপানে যাওয়ার সুযোগ পায়। ওইসব ফ্লাইটে যাওয়া যাত্রীদের প্রত্যেকে নেগেটিভ রিপোর্ট দিয়েই ফ্লাইটে উঠেছিলেন।  কিন্তু জাপান যাওয়ার পর পরীক্ষা করলে তাদের মধ্যে চারজনের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে মে মাসের প্রথমদিকে শর্ত আরোপ করে জাপান। একই ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ কোরিয়াগামী চার্টার্ড ফ্লাইটের আরোহী যাত্রীদের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশে পরীক্ষা চালিয়ে এসব যাত্রীর সংক্রমণ শনাক্ত না হলেও দক্ষিণ কোরিয়ায় পরীক্ষা চালিয়ে পাঁচজন সংক্রমিতকে শনাক্ত করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র বলছে, দেশের বাইরে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়ার কিছু রিপোর্ট পাওয়া গেছে। তারা বাংলাদেশ থেকে ভুয়া রিপোর্ট নিয়ে গিয়ে তাদের সেখানে করোনা হয়েছে। ফলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। মূলত বিদেশযাত্রা কিংবা যেসব প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগদানের জন্য করোনা নেগেটিভ সনদপত্র দরকার সেসব লোকদের টার্গেট করে তৎপরতা চালিয়ে আসছিল একটি চক্র। হাসপাতালে স্যাম্পল দিতে আসা লোকজনের কাছে বিক্রি করা হয় ভুয়া সনদপত্র। যার জন্য নেওয়া হতো ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা। র‌্যাবের দাবি, এখন পর্যন্ত চক্রটি ১৫০-২০০টি ভুয়া সনদ বিক্রি করেছে। রাজধানীজুড়ে যে কয়টি করোনা টেস্ট কেন্দ্র রয়েছে তার সবগুলোতে সক্রিয় চক্রটি। জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ৬০টি ল্যাবে পরীক্ষা চলছে, যার ৩০টিই ঢাকায় এবং ১৭টি ল্যাব সাতটি জেলায়। ২০টি জেলায় ল্যাব স্থাপন হলেও ৪৪টি জেলায় কোনো ল্যাব স্থাপন করা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রয়োজন আছে, এমন অনেক মানুষ টেস্ট করাতে পারছেন না। টেস্টের কেন্দ্রগুলোর সামনে উপচে পড়া ভিড়। তাদের মধ্যে কম সংখ্যক মানুষই টেস্ট করাতে সক্ষম হচ্ছেন। আবার লাইনে দাঁড়াতে গিয়ে সামাজিক দূরত্বও নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে করে সুস্থ ব্যক্তিরও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। আবার টেস্ট করার পর রেজাল্ট পেতে তিন-চার দিন অনেক ক্ষেত্রে সাত দিনও লেগে যাচ্ছে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। উপসর্গ থাকায় হাসপাতালগুলোও নিচ্ছে না রোগীদের। এ পরিস্থিতিতে টেস্টের সুযোগ সম্প্রসারণের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, টেস্ট করার সুবিধা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হবে। প্রয়োজন আছে, এমন সবাই যেন পরীক্ষা করাতে পারেন। একই সঙ্গে পরীক্ষার ব্যয় নাগালের মধ্যে রাখতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, আমরা আমাদের সাধ্যমতো টেস্টের আওতা বাড়ানোর চেষ্টা করেছি। বর্তমানে ৬০টি ল্যাবে পরীক্ষা হচ্ছে। লোকবল নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আশা করি অবিলম্বে টেস্টের হার আরও বাড়বে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর