বুধবার, ১৭ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে লুটছে মুনাফা

করোনাকালে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে জমজমাট ব্যবসা

জয়শ্রী ভাদুড়ী, ঢাকা ও রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে লুটছে মুনাফা

করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালের অনেকগুলোতেই নেই সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা। কারও শ^াসকষ্ট দেখা দিলে জীবন বাঁচাতে সিলিন্ডার অক্সিজেন ব্যবহার করছে হাসপাতালগুলো। বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেওয়া অনেক রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ব্যবহার করছেন অক্সিজেন। এ সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা মজুদ বাড়িয়ে তৈরি করছে কৃত্রিম সংকট। আগে বছরে ৬৫ হাজার অক্সিজেন সিলিন্ডার দরকার হতো। এখন করোনা রোগীর জন্য চাহিদা বেড়ে ৫ লাখ সিলিন্ডারে পৌঁছেছে। হঠাৎ করে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা অক্সিজেনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মুনাফা লুটছে। বাংলাদেশ সোসাইটি অফ এনেসথেসিওলজিস্টসের সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এনেসথেসিয়া বিভাগের অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, চিকিৎসায় যখন অক্সিজেন ব্যবহার হয় তখন সেটা একটা থেরাপি। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কখনোই অক্সিজেন ব্যবহার করা যাবে না। রোগীর সেচুরেশন কত, ক্যানোলা নাকি মাস্ক কীভাবে অক্সিজেন দেওয়া হবে সেটা চিকিৎসক বুঝতে পারবেন। কখন অক্সিজেন বাদ দিয়ে অন্য চিকিৎসায় যেতে হবে সেটাও তো চিকিৎসক ছাড়া বোঝা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রশিক্ষিত কেউ না খুললে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। একটু ভুল হলে আগুনে সব ঝলসে যাবে। রোগীকে অক্সিজেন দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষিত ব্যক্তির প্রয়োজন। অযথা বাড়িতে সিলিন্ডার মজুদ করে রাখলে প্রয়োজনের সময় মুমূর্ষু রোগীরা পাবে না। কোনটা সঠিক সিলিন্ডার না জেনে প্রতারণার শিকার হচ্ছে মানুষ।

 

অক্সিজেন উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে দুই ধরনের অক্সিজেন উৎপাদন হয়; মেডিকেল অক্সিজেন ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন। মেডিকেল অক্সিজেন পাইপ লাইনের মাধ্যমে হাসপাতালে সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া আইসিইউতে পাইপলাইন ছাড়া সিলিন্ডার অক্সিজেনও রয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে বসানো অক্সিজেনের বড় ট্যাংকগুলোতে ৫ টন থেকে ২০ টন অক্সিজেন ধারণক্ষমতা থাকে। কিন্তু নতুন অনেক সরকারি হাসপাতালে পাইপলাইনে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। করোনা রোগীদের নির্ধারিত কুর্মিটোলা হাসপাতালে সিলিন্ডার অক্সিজেনই ভরসা। অক্সিজেন সিলিন্ডার সংকটের সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা জালিয়াতি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ডের শয্যা ১০০। কিন্তু দৈনিক গড়ে ভর্তি থাকে ১৪০ থেকে ১৫০ জন রোগী। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ রোগীর অক্সিজেন সেবার দরকার হয়। অথচ সেখানে অক্সিজেন পোর্টাল আছে মাত্র ৩৫টি। শয্যার রোগীরা ভাগাভাগি করে এসব পোর্টাল থেকে অক্সিজেন সুবিধা পেলেও ফ্লোরে থাকা রোগীদের ভাগ্যে তা জোটে না। বর্তমানে সাধারণ সময়ের তুলনায় মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা কয়েকগুণ বেশি বেড়েছে। এ চাহিদাকে পুঁজি করে একটি অসাধু চক্র তিনগুণ পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছে। তৈরি করেছে কৃত্রিম সংকট। অন্তহীন দুর্ভোগে পড়েছেন রোগীরা। টাকা দিয়েও মিলছে না অক্সিজেন। সিলিন্ডারে রিফিল নিয়েও পড়তে হচ্ছে সংকটে। জানা যায়, সাধারণ সময়ে এক সিলিন্ডার অক্সিজেন রিফিলে ১২২ টাকা হলেও এখন নেওয়া হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। ১১ হাজার টাকার অক্সিজেন সিলিন্ডার চট্টগ্রামে বিক্রি করা হচ্ছে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। একই সঙ্গে সিলিন্ডারের মান নিয়ে করছে চরম কারসাজি। মেডিকেল সিলিন্ডারে যে অক্সিজেন দিচ্ছে, তাতে থাকে না কাক্সিক্ষত মাত্রার ঘনত্ব। বাণিজ্যিকভাবে তৈরি ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের কম ঘনত্বের অক্সিজেনকে বিক্রি করছে মেডিকেল অক্সিজেন হিসেবে। লিন্ডে, স্পেকট্রাম ও ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেডের পুরনো সিলিন্ডারে রিফুয়েলিং করে বিক্রি করা হচ্ছে চড়া দামে। এসব অক্সিজেন জমা করা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডারে। ফলে রোগী বাঁচাতে ব্যবহার করা এসব সিলিন্ডার উল্টো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।  

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আবদুর রব বলেন, ‘বাণিজ্যিক অক্সিজেনে ঘনত্ব থাকে সাধারণত ৬০-৭০ শতাংশ। কিন্তু এক দশমিক চার কিউবিক লিটার মেডিকেল অক্সিজেন সিলিন্ডারে ঘনত্ব থাকে ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশের কাছাকাছি। কাক্সিক্ষত মাত্রার ঘনত্ব না থাকলে রোগী অক্সিজেন থেকে উপকার পাবে না। শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত রোগীর জন্য অক্সিজেন জরুরি মেডিকেল উপাদান।’ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে মেডিকেল গ্রেড পিউরিটির অক্সিজেন প্রস্তুতের বৈধ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সরকারি বেসরকারি মালিকানার লিন্ডে বাংলাদেশ, বেসরকারি আছে স্পেকট্রাম অক্সিজেন লিমিটেড ও নারায়ণগঞ্জের ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড। দেশের কোথাও এসব কোম্পানির ডিলার নেই। হাসপাতালে থাকা প্লান্টে তারা নিজেরাই অক্সিজেন সরবরাহ করে। ডাক্তারের চিকিৎসাপত্র ও এনআইডি কার্ড থাকলে ব্যক্তিগত পর্যায় কিংবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে তারা এক দশমিক চার কিউবিক বা এক হাজার ৪০০ লিটারের অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রয় করেন। তাই বাইরে বিক্রি হওয়া সিলিন্ডারগুলোর মান প্রশ্নবিদ্ধ।’ অভিযোগ আছে, চট্টগ্রামে সিলিন্ডার সংকটের নেপথ্যে সক্রিয় আছে নগরের কাজীর দেউড়ির হাসান ট্রেডার্স, সদরঘাটের ব্রাদার্স প্রকৌশলী ওয়ার্কস, চকবাজার কাতালগঞ্জের বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ এবং কর্ণফুলীর জিলানী অক্সিজেন লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠানের সহযোগী হিসেবে আছে আরও ১১টি প্রতিষ্ঠান। সিলিন্ডারে অনিয়ম করতে বিক্রির সময় রাখা হয় না কোনো প্রমাণ। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন গত ৮ ও ৯ জুন উচ্চমূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি ও রিফিল করা, কোনো ধরনের ব্যবসায়িক প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে না পারা, বিস্ফোরক অধিদফতরের লাইসেন্স না থাকা, বৈধ প্রতিষ্ঠান লিন্ডে বাংলাদেশের সিল বসিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি, বিক্রয় ক্যাশ মেমোতে টাকার অঙ্ক ও ক্রেতার নাম-ঠিকানা না থাকা, প্রকাশ্যে সিলিন্ডার বিক্রি না করে গোপনে বিক্রয় করা, গোডাউনে সিলিন্ডার থাকলেও ক্রেতাদের কাছে নেই বলে বিশেষ ক্ষেত্রে বেশি দামে বিক্রয় করার অভিযোগে এসব প্রতিষ্ঠানকে চার লাখ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করে। অভিযান পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. উমর ফারুক বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্যই হলো সিলিন্ডার সরবরাহ যাতে বন্ধ না হয়। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লিন্ডে ও স্পেকট্রাকে কঠোরভাবে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে জেলা প্রশাসন নিয়মিত মনিটরিং করছে, যাতে কেউ অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি বা রিফিলে বেশি মূল্য না নিতে পারে। অভিযোগ পেলেই চলবে অভিযান। তাছাড়া অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতেও নজরদারি করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকট নেই। চাহিদা বিবেচনায় ২০ জুনের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে আরও চার হাজার মেডিকেল গ্রেড সিলিন্ডার আমদানি করা হচ্ছে বলে লিন্ডে বাংলাদেশের বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিনিধিরা জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছেন।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর