শিরোনাম
বুধবার, ১৭ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

দেশীয় সিমেন্ট শিল্প ধ্বংসের পাঁয়তারা

প্রি-ফেব্রিকেটেড স্টিল বিল্ডিং আমদানিতে শুল্কমুক্ত অন্যায্য কর সুবিধা, অর্থনৈতিক অঞ্চলের নামে আমদানি পণ্য যাচ্ছে কালোবাজারে, স্টিল বিল্ডিং আমদানিতে শুল্ক আরোপের পরামর্শ শিল্প মন্ত্রণালয়ের

রুহুল আমিন রাসেল

দেশীয় সিমেন্ট শিল্প ধ্বংসের পাঁয়তারা

অন্যায্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় প্রি-ফেব্রিকেটেড স্টিল বিল্ডিং আমদানির মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশীয় সিমেন্ট শিল্প ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্থানীয় স্টিল শিল্পও।

অর্থনৈতিক অঞ্চলের নামে আমদানি হওয়া প্রি-ফেব্রিকেটেড স্টিল বিল্ডিং কালো বাজারে বিক্রি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, অসাধু চোরাকারবারি ব্যবসায়ীরা কি আইনের ঊর্ধ্বে? নইলে কীভাবে তারা ইপিজেডের নামে স্টিল বিল্ডিং আমদানি করে কালোবাজারে বিক্রির সাহস পায়। তারা জাতীয় স্বার্থে প্রি-ফেব্রিকেটেড স্টিল বিল্ডিং আমদানি বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। বলেছেন, অন্যথায় সরকারের রাজস্ব আয় হুমকিতে পড়বে। একদিকে দেশীয় সিমেন্ট শিল্প ধ্বংস হবে অন্যদিকে আমদানিতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হবে। করোনাকালে এই সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান সিমেন্ট শিল্প মালিকরা। বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন-বিসিএমএ তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে সক্রিয় সিমেন্ট উৎপাদন কারখানা রয়েছে ৩৫টি। সারা দেশে সিমেন্টের চাহিদা ৩৫ মিলিয়ন টন হলেও কারখানাগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ৮০ মিলিয়ন টন। আগামী তিন বছরে সিমেন্ট উৎপাদন ক্ষমতায় আরও ১১ মিলিয়ন টন যুক্ত হবে। দেশে সিমেন্টের বার্ষিক চাহিদা প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টন। এ খাতে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। ফলে সরকারি কোষাগারে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাজস্বও যায়। পাশাপাশি সরকার সিমেন্ট কোম্পানিগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ আয়করও পেয়ে থাকে। এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কয়েক লাখ শ্রমিক-কর্মচারি জড়িত রয়েছেন।  জানা গেছে, উল্লেখিত প্রেক্ষাপটে প্রি-ফেব্রিকেটেড স্টিল বিল্ডিং আমদানিতে অন্যায্য শুল্কমুক্ত সুবিধার ফলে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশীয় সিমেন্ট শিল্প হুমকিতে পড়েছে। শুল্কমুক্ত বন্ড সুবিধায় বাড়ছে চোরাচালান। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে গড়ে ওঠা সিমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিমেন্ট শিল্প যেখানে স্বয়ং সম্পূর্ণ, সেখানে প্রি-ফেব্রিকেটেড স্টিল বিল্ডিং আমদানির প্রয়োজন কি? এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার এমপি সোমবার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের দেশের স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্প খাতের সুরক্ষায় আমদানি হওয়া শুল্কমুক্ত সুবিধায় প্রি-ফেব্রিকেটেড স্টিল বিল্ডিংয়ের ওপর বাড়তি শুল্করোপ করা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয় দেশি শিল্প সুরক্ষা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে দিয়েছে বলেও তিনি জানান। বিসিএমএ সভাপতি ও ক্রাউন সিমেন্ট গ্রুপের ভাইস-চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রি-ফেব্রিকেটেড স্টিল বিল্ডিং আমদানিতে অন্যায্য কর সুবিধা দেওয়ায় স্থানীয় স্টিল মিলগুলোকে তো কোনো সুরক্ষা দেওয়া হলো না। বরং দেশীয় শিল্পের ক্ষতি হলো। প্রি-ফেব্রিকেটেড স্টিল বিল্ডিং সামগ্রী আমদানিতে সিমেন্টের ব্যবহার কমে যাবে। এতে শুধু দেশীয় শিল্পের ক্ষতি হবে না, আমদানি খরচ প্রচুর বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা ডলারও হাতছাড়া হবে। আবার প্রি-ফেব্রিকেটেড স্টিল বিল্ডিংয়ের নিরাপত্তা ঝুঁকিও রয়ে গেছে। বিষয়টি বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। বিসিএমএ জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া, অসমন্বয়যোগ্য অগ্রিম আয়কর, তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে সিমেন্টের নিম্নমুখী দামের প্রবণতা এবং নদী ও সড়কপথে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রায় সব সিমেন্ট কোম্পানি ক্ষতির সম্মুখীন। লকডাউন শুরু হওয়ার পর সিমেন্ট কারখানাগুলোতে ৯০ ভাগ উৎপাদন বন্ধ ছিল, যেটা এখন ৬০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। খুচরা বাজার মূল্য অনুযায়ী বাংলাদেশে করোনা শনাক্তের পর থেকে এ পর্যন্ত সিমেন্ট খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।

বিসিএমএ জানিয়েছে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে অগ্রিম আয়কর পাঁচ শতাংশ নির্ধারণ করা হয় এবং তা অসমন্বয়যোগ্য। কিন্তু পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে অগ্রিম আয়কর চূড়ান্ত দায় হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। কোনো কোম্পানি মুনাফা করুক বা লোকসান করুক, তাকে পাঁচ শতাংশ অগ্রিম আয়কর দিতেই হবে। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় এটা থাকা উচিত নয়। সিমেন্ট উদ্যোক্তারা সরকারি নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে অনেক দেন-দরবারের পর যদিও এই অগ্রিম আয়কর তিন শতাংশ করা হয়েছে। কিন্তু উদ্যোক্তারা চান এই অগ্রিম আয়কর সম্পূর্ণ বাতিল হোক। বিসিএমএ জানিয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত সব সিমেন্ট কোম্পানির সম্মিলিতভাবে ৭৫০ কোটি টাকারও বেশি অসমন্বিত অগ্রীম আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে আছে। ১০ শতাংশ হারে সুদ বিবেচনায় নেওয়া হলে সিমেন্ট খাতটি শুধু সুদ হিসেবে প্রতি বছর ৭৫ কোটি টাকা হারাচ্ছে। যদিও আয়কর আইন মোতাবেক করদাতার পরিশোধিত টাকা পরিশোধযোগ্য করের চেয়ে বেশি হলে তা ফেরত পাওয়ার যোগ্য। ফেরত দিতে দেরি হলে সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত না ফেরত দেবে, ততক্ষণে সাড়ে সাত শতাংশ হারে সুদ প্রদান করবে। কিন্তু বছরের পর বছর বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও তা নগদে ফেরত পাওয়া যায় না।

সর্বশেষ খবর