বুধবার, ১৭ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা
বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল

কোটি কোটি টাকায় কেনা নতুন যন্ত্রপাতি সবই অচল

রাহাত খান, বরিশাল

বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগ নির্ণয় ও জটিল অপারেশনের জন্য কোটি কোটি টাকায় কেনা ভারী যন্ত্রপাতিগুলো কৃত্রিমভাবে অচল করে রাখার অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে যন্ত্রপাতির ওপর ভর করে বেসরকারি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো ফুলে ফেঁপে উঠলেও দক্ষিণাঞ্চলের উন্নত চিকিৎসার ভরসাস্থল শেরেবাংলা মেডিকেলের যন্ত্রপাতিগুলো বিকল হচ্ছে রহস্যজনকভাবে। শেরেবাংলা মেডিকেলের টেকনোলজিস্টদের অনেকে নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবসায়িক অংশীদার এবং অনেকের আর্থিক যোগসাজস রয়েছে তাদের সঙ্গে। এ কারণে সচল যন্ত্রপাতি অচল করে মেডিকেলের রোগীদের বাইরে যেতে  বাধ্য করছে তারা। মুমূর্ষু রোগীর জীবন রক্ষায় ৩ বছর আগে এই হাসপাতালে স্থাপিত ১০ শয্যার আইসিইউ বেড অব্যবহৃত অবস্থায় কার্যকারিতা হারায়। বেডগুলো অচল থাকায় অনেক মুমূর্ষ রোগী মারা যায়। করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে ওই ১০টি আইসিইউ বেড মেরামত করে সচল করাসহ এবং করোনা ওয়ার্ডে ১৮টি নতুন আইসিইউ বেড স্থাপন করা হয়। তবে আইসিইউ ইউনিটের জন্য এখনো চিকিৎসক পদায়ন করা হয়নি। অন্য বিভাগের চিকিৎসক দিয়ে কোনো মতে চালু রয়েছে আইসিইউ সেবা। রোগীদের রোগ নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ আল্ট্রাসনোগ্রাম হয় না গত এক বছর ধরে। দুটি আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনের দুটিই বিকল থাকায় সেবাবঞ্চিত রোগীরা। মস্তিষ্কে, হাড়ে কিংবা শরীরের মধ্যের জটিল রোগ নির্ণয়ের জন্য কোটি কোটি টাকায় কেনা এমআরআই মেশিন দুই বছর ধরে বিকল। এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই পরীক্ষা বন্ধ। ক্যান্সারের রোগীর রেডিয়েশন দেওয়ার জন্য খুলনা এবং বরিশাল বিভাগের একমাত্র কোবাল্ট-৬০ মেশিন রয়েছে শেরেবাংলা মেডিকেলে। অথচ গত ২ বছর বছর ধরে এই মেশিনটি বিকল অবস্থায় রয়েছে। অত্যাধুনিক ২টি সিটি স্ক্যান মেশিনের একটি ১ বছর ধরে এবং অপরটি গত ৮ মাস ধরে বিকল। এ কারণে হাসপাতালে আগত মস্তিস্কে আঘাতসহ জটিল রোগীদের অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে সিটি স্ক্যান করতে হয় বাইরের বিভিন্ন সিটি স্ক্যান সেন্টারে। এই হাসপাতালের ৬টি এক্স-রে মেশিনের ৪টিই অচল দীর্ঘদিন ধরে। আধুনিক এই ডিজিটাল মেশিন দিয়ে এক্স-রে করলে আল্ট্রাসনোগ্রামও প্রয়োজন হয় না দাবি বিশেষজ্ঞদের। গুরুত্বপূর্ণ কিডনি ও লিভার এক্স-রে করার ব্যবস্থা থাকলেও টেকনিশিয়ানের সংকট দেখিয়ে এই এক্স-রে বন্ধ রয়েছে। ৬টি এক্স-রে মেশিনের ৪টি অচল থাকায় ২টি মেশিন দিয়ে এক্স-রে করাতে রোগীদের দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হয়। হয়রানি আর টেকনোলজিস্টদের রুক্ষ ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে সেবাপ্রত্যাশীরা চলে যান বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। হাসপাতালের প্যাথলজিতে হরমোন, অ্যালার্জি ও যৌন রোগের পরীক্ষা হয় না রি-এজেন্ট সংকটের অজুহাতে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে রি-এজেন্ট সংগ্রহের উদ্যোগ নেই। প্যাথলজিতে রয়েছে জনবল সংকটও। ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাক্সবন্দী পড়ে থাকার পর ২ বছর আগে হৃদরোগীদের সেবায় চালু হয় এনজিওগ্রাম মেশিন। দেড় বছরে কয়েক শ রোগীর এনজিওগ্রাম করা হয় স্বল্প টাকা খরচে। অথচ গত ৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে এনজিওগ্রাম মেশিনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। হাসপাতালের ইটিটি মেশিনটিও বিকল পড়ে আছে গত ১ বছর ধরে। এই মেশিনটি চালু থাকলে এনজিওগ্রাম করার তেমন প্রয়োজন হতো না হৃদরোগীদের। চক্ষু রোগীদের সেবায় ৫ বছর আগে ১২ কোটি টাকায় কেনা লেসিক মেশিনটি গত ১ বছর ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে। অথচ লেসিক করালে চশমা ব্যবহারের তেমন প্রয়োজন হতো না চক্ষু সমস্যাগ্রস্ত রোগীদের। চোখের ছানি অপারেশনের ফেকো মেশিনও বিকল গত ৪ বছর ধরে। দেশের সব হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা রোগ পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও একমাত্র শেরেবাংলা মেডিকেলে জনবল সংকটের দোহাই দিয়ে পরীক্ষা হয় সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। এ কারণে পরীক্ষা করাতে না পেরে প্রতিদিন বাইরের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিতে ভিড় করছেন রোগীরা। অভিযোগ রয়েছে শেরেবাংলা মেডিকেলের সামনে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা ডায়াগনস্টিক ও প্যাথলজির ব্যবসায়িক অংশীদার হাসপাতালের টেকনোলজিস্টরা। হাসপাতালের অনেক ডাক্তার-কর্মচারীদেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে তাদের সঙ্গে। সিন্ডিকেট করে হাসপাতালের ভারী আধুনিক যন্ত্রপাতিগুলো কৃত্রিমভাবে অচল করে রোগীদের বাইরে যেতে বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে। বাইরে রোগ পরীক্ষার নির্দিষ্ট কমিশন পৌঁছে যায় হাসপাতালের ডাক্তার ও আয়াদের কাছে। শেরেবাংলা মেডিকেলের সামনে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, হাসপাতালের যে কোনো রোগীকে ডায়াগনস্টিকে নিয়ে গেলে পরীক্ষা ফির ৩০ ভাগ আয়া-বুয়া এবং ৩০ ভাগ সংশ্লিস্ট চিকিৎসককে দিতে হয়। শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. বাকির হোসেন হাসপাতালের ভারী যন্ত্রপাতিগুলো বিকল থাকার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, কোটি কোটি টাকায় মূল্যবান মেশিন কেনা হয়। এতে এক শ্রেণির মানুষের ব্যবসা হয়। অথচ এগুলো চালানোর জন্য কোনো দক্ষ ও যোগ্য জনবল নেই হাসপাতালে। এসব আধুনিক যন্ত্রপাতি পরিচালনার জন্য হাসপাতালে অন্তত ২ জন বায়োমেডিকেল প্রকৌশলী প্রয়োজন। কিন্তু শেরেবাংলা মেডিকেলে বায়োমেডিকেল প্রকৌশলীর পদই সৃষ্টি হয়নি আজ পর্যন্ত। ৬৮ সালের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী ২২৪ জন ডাক্তারের পদ থাকলেও কর্মরত আছেন ৯৬ জন। প্রয়োজনীয় টেকনোলজিস্টও নেই। তাহলে কীভাবে সব কিছু ঠিকখাট থাকবেথ- প্রশ্ন রাখেন পরিচালক।

সর্বশেষ খবর