শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

ল্যাবে নমুনার স্তূপ

করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট মিলছে না ১৫ দিনেও, আতঙ্কিত মানুষ বাড়ছে দুর্ভোগ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ল্যাবে নমুনার স্তূপ

ছোট্ট শিশুটি বাবার সঙ্গে গতকাল ঢাকা মেডিকেলে করোনা পরীক্ষার জন্য আসে -রোহেত রাজীব

সাত দিন জ্বর, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্টে ভোগার পর ৩১ মে টঙ্গীর শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার স্কুলের বুথে করোনা টেস্টের জন্য নমুনা দিয়েছিলেন বাবুল দেওয়ান (৬৫) ও তার পরিবারের দুই সদস্য। নমুনা দেওয়ার ১৭ দিন পেরিয়ে গেলেও তারা টেস্টের প্রতিবেদন এখনো পাননি। বাবুল দেওয়ানের ছেলে আল-আমিন দেওয়ান এরই মধ্যে টেস্টের রেজাল্টের জন্য ব্র্যাক, আইইডিসিআর, স্বাস্থ্য অধিদফতরে কয়েক দফা যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু এখনো রিপোর্ট পাননি তারা। এরই মধ্যে বাবুল দেওয়ানের দুই মেয়ে ও স্ত্রী  জ্বর-শ্বাসকষ্টে ভুগছে। টেস্ট রিপোর্ট না পাওয়ায় পুরো পরিবারের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে।

সারা দেশে মাত্র ৬০টি ল্যাবে চলছে করোনাভাইরাস শনাক্ত টেস্ট। উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালের দুয়ারে ঘুরছে মানুুষ, হটলাইন নম্বরে বাড়ছে উপসর্গ থাকা রোগীদের কল। অনেক চেষ্টায় করোনা টেস্টের জন্য নমুনা দিলেও ১৫ দিনে মিলছে না প্রতিবেদন। নমুনা সংগ্রহের এত দিন পরে প্রতিবেদন দেওয়ায় নমুনার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। একই সঙ্গে স্পষ্ট হচ্ছে করোনার নমুনা সংগ্রহ ও ল্যাবে শনাক্তকরণ কাজে প্রয়োজনীয় জনবলের সংকট। সংকটের কারণে ল্যাবগুলোতে জমছে নমুনার স্তূপ। আবার উপসর্গ নিয়ে টেস্টের জন্য অপেক্ষমাণ মানুষের তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে। টেস্ট করতে না পারা এবং নমুনা দিয়ে ১৫ দিনেও প্রতিবেদন না পাওয়ায় মানুষের আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা বাড়ছে। টেস্ট নিয়ে এই টানাপড়েনে সামাজিকভাবে হয়রানি হচ্ছে মানুষ। মনোবল হারাচ্ছে রোগীরা। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেন, নমুনা বেশি হওয়ায় ল্যাবগুলোতে জমে যাচ্ছে। তাই রিপোর্ট পেতে দেরি হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে আমরা কাজ করছি। গত ২৭ মে জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও হালকা গলাব্যথা নিয়ে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে নমুনা দেন কক্সবাজারের এক বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ইয়াসফিনাউল হক। নমুনা দেওয়ার ১৯ দিন পর ১৪ জুন তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের এসএমএস পান যে তার করোনা টেস্টের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। তবে সেই এসএমএসে বলা হয় তার নমুনা রিসিভ করা হয়েছে ৬ জুন। ২৭ মে নমুনা দেওয়ার পর তা ৬ জুন রিসিভ করা হলে রিপোর্ট কতটা বিশ্বাসযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ওই চিকিৎসকের পরিবারের সদস্যরা। গত ৩ জুন করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মারা যান রংপুরের পীরগাছার ইলিয়াস হোসেন। মৃত্যুর পর তার নমুনা সংগ্রহ করা হলেও রিপোর্ট পাওয়া যায় আট দিন পর ১১ জুন। সে দিন জানা যায়, করোনা পজিটিভ ছিলেন ইলিয়াস হোসেন। এরই মধ্যে ইলিয়াস হোসেনের স্ত্রী পীরগাছা থেকে নীলফামারীতে তার বাবার বাড়িতে চলে গেছেন। সেখানে তার সংস্পর্শে এসেছে তার আত্মীয়রা। আট দিন পর টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ জানার পর এখন সবাই কোয়ারেন্টাইনে আছেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘টেস্টের পরিধি বাড়িয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। কারণ চিকিৎসার জন্য টেস্ট করা হয় না। টেস্টের মূল উদ্দেশ্য রোগীকে আলাদা করা যাতে সংক্রমণ কমে। কিন্তু রিপোর্ট পেতে দেরি হওয়ায় সে উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। এতে রোগীর ভোগান্তি বাড়ছে, রাষ্ট্রেরও অর্থের অপচয় হচ্ছে।’ নমুনা সংগ্রহ করার কত দিনের মধ্যে টেস্ট করলে রিপোর্ট সঠিক হতে পারে জানতে চাইলে এই চিকিৎসক বলেন, ‘ভাইরাস সংগ্রহ করে ভাইরাস ট্রান্সপোর্ট মিডিয়াম (ভিটিএম) এ চার থেকে আট ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখা হলে ভাইরাস তিন দিন জীবিত থাকে।’ ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নমুনা নেওয়ার পর ঠিকমতো কোল্ড চেইন না মানলে টেস্টের রিপোর্ট ভুল আসতে পারে। সেক্ষেত্রে নুমনা নেওয়ার ১০-১৫ দিন পর রিপোর্ট পেলে সেই রিপোর্ট কতটা সঠিক তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।’

চট্টগ্রামে প্রতিদিন গড়ে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে ১২০০-১৫০০টি। তবে নমুনা পরীক্ষা হয় ৬০০-৮০০টি। সংগ্রহের তুলনায় পরীক্ষা করার সক্ষমতা কম হওয়ায় নমুনার স্তূপ পড়ে গেছে চট্টগ্রামে। তাই গত ১০ জুন প্রায় চার হাজার নমুনা পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠাতে হয়েছে। ঢাকায় পাঠানোর পর আবারও নমুনা জট শুরু হয়েছে চট্টগ্রামে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) ল্যাব প্রধান ডা. শাকিল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রতিদিন ৬০০টি নমুনা আসে। কিন্তু ২৫০-৩০০টি পরীক্ষা করার সক্ষমতা এখানে রয়েছে। বাকিগুলো সংগ্রহ করতে হয়। ঢাকায় পাঠানোর পরে আবারও জট লেগে গেছে। গত চার দিনে হাজারখানেক নমুনা জমে গেছে।’ করোনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবগুলোতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং দক্ষ ও পর্যাপ্ত মেডিকেল টেকনোলজিস্টের অভাব রয়েছে। অভাব রয়েছে ভাইরোলজিস্টেরও। সরকারের করোনাবিষয়ক ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘৬০টি ল্যাবে এখন করোনা টেস্ট করা হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ ল্যাবই দুই-একজন টেকনোলজিস্ট নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। নমুুনা সংগ্রহ থেকে পরীক্ষা সব ক্ষেত্রে জনবল সংকট প্রকট। এখন সংক্রমণ বাড়ায় নমুনা অনেক বাড়ছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর