বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

ডেক্সামেথাসন নিয়ে দেশ-বিদেশে আশা

দেশে আইভারমেকটিনের পরীক্ষামূলক গবেষণা

প্রতিদিন ডেস্ক

ব্রিটেনের একদল গবেষক করোনাভাইরাস চিকিৎসায় ডেক্সামেথাসন নিয়ে সবচেয়ে বড় সুখবরটি দেওয়ার পর এটি নিয়ে এখন দেশ-বিদেশে নতুন আশাবাদ তৈরি হয়েছে। সূত্র : বিবিসি। গবেষকরা বলেছেন, করোনাভাইরাস থেকে জীবন রক্ষাকারী প্রথম ওষুধের সন্ধান পাওয়া গেছে, যার নাম ডেক্সামেথাসন। তারা এক বিবৃতিতে জানান, করোনা আক্রান্ত রোগীদের ওপর এই ওষুধটি দারুণ কার্যকর ফলাফল দিচ্ছে। গত মার্চ থেকে গবেষণা চালিয়ে তারা দেখেছেন, জেনেরিক স্টেরয়েড ‘ডেক্সামেথাসন’-এর স্বল্প মাত্রায় ব্যবহার  ভেন্টিলেটরে থাকা করোনা রোগীদের মৃত্যুহার ৪০ শতাংশ থেকে ২৮ শতাংশে নামিয়ে আনে। অক্সিজেন সাহায্যে থাকা রোগীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুহার ২৫ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়ায় ২০ শতাংশে। যুক্তরাজ্যে যদি প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে এই ওষুধটি সবাইকে দেওয়া হতো তাহলে অন্তত পাঁচ হাজার  লোক কম মারা যেত। তারা আরও জানান, এটি স্বল্প মূল্যের একটি ওষুধ। এর কারণে কম আয়ের  দেশগুলোতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া আরও সহজ হয়ে যাবে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ম্যাসাচুসেটস  জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের পরিচালক ডক্টর ক্যাথরিন হিবার্ট বলেছেন, ‘আমার আশা, তাদের এই গবেষণার তথ্য সঠিক হবে। যদি তাই হয়, তাহলে যন্ত্রণায় ভুগতে থাকা রোগীরা একটু স্বস্তি পাবে।’ একইভাবে এই ওষুধটি নিয়ে আরও বিভিন্ন দেশে আশাবাদ তৈরি হয়েছে। জানা গেছে, ভারতীয় মূল্যে  মোটামুটি ২০ টাকা দামের ডেক্সামেথাসোন ১৯৬০ সাল থেকেই বাতজনিত সমস্যা, চর্মরোগ, মারাত্মক অ্যালার্জি, হাঁপানি, দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগের চিকিৎসায় প্রয়োগ করা হয়। নির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সারের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এই স্টেরয়েডের প্রয়োগ করা হয়। ওয়াকিবহালরা বলছেন, বিশ্বের প্রায় সব  দেশেই এই ওষুধ সুলভ মূল্যেই পাওয়া যায়। তাই এই ওষুধের হাত ধরে খুব দ্রুত করোনার চিকিৎসায় বড়সড় পরিবর্তন আসতে চলেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাস প্রধানত সংক্রমণ ঘটায় ফুসফুস ও রক্তনালীতে। এ ভাইরাস প্রতিরোধে রক্তের শ্বেত কণিকাসহ বিভিন্ন এন্টিবডি যখন সংক্রমণস্থলে আসতে থাকে তখন রক্ত জমাট বাঁধাসহ নানা প্রদাহে ক্ষতির মুখে পড়ে ফুসফুস। চিকিৎসকরা বলছেন, ঠিক এ জায়গাটিতেই কাজ করে স্টেরয়েড ডেস্কামেথাসন।

আইভারমেকটিনের পরীক্ষামূলক গবেষণা শুরু আইসিডিডিআরবির : আইসিডিডিআরবি কভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসায় পরজীবীনাশক ওষুধ আইভারমেকটিন ব্যবহারের কার্যকারিতা যাচাইয়ে পরীক্ষামূলক গবেষণা শুরু করেছে। স্বাস্থ্য সংস্থাটি আইভারমেকটিনের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক ডক্সিসাইক্লিন ব্যবহারের কার্যকারিতা যাচাই করে দেখছে। গতকাল থেকে পরীক্ষামূলক এ গবেষণা শুরু করা হয়। কভিড-১৯ চিকিৎসায় নিয়োজিত হাসপাতালে ভর্তি থাকা প্রাপ্তবয়স্ক রোগীদের নিয়ে গবেষণাটি পরিচালনা করা হবে। আইভারমেকটিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অনুমোদনপ্রাপ্ত একটি ওষুধ, যা ১৯৮০ সাল থেকে পরজীবীজনিত সংক্রমণ প্রশমনে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অতীতে দেখা গেছে, গবেষণাগারে অনেক ধরনের ভাইরাসনাশক হিসেবেও এটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এ গবেষণায় কভিড-১৯-এর চিকিৎসায় নিয়োজিত ঢাকার চারটি হাসপাতালের ৭২ জন রোগীকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। গবেষণাটি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল এবং মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সঙ্গে শুরু হয়েছে। বাকি হাসপাতালগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে।

কভিড-১৯ সংক্রমণের হার এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত অসুস্থতা ও মৃত্যুর হার নজিরবিহীন। বিশ্বব্যাপী ৮২ লাখেরও বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং গত পাঁচ মাসে আক্রান্ত প্রায় ৪ লাখ ৪৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে ৯৪ হাজার ৪৮১ জন করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন এবং ১ হাজার ২৬২ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। এ রোগে আক্রান্ত হলে সংক্রমণ সাধারণত হালকা (কাশি, জ্বর) থেকে তীব্র (নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট) শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বয়োবৃদ্ধ এবং যাদের অন্য কোনো গুরুতর অসুস্থতা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এ রোগ মৃত্যুরও কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এই গবেষণার লক্ষ্য হলো আইভারমেকটিনের সঙ্গে ডক্সিসাইক্লিন অথবা শুধু আইভারমেকটিনের সাহায্যে চিকিৎসা প্রদান করলে ভাইরাসের সংক্রমণ কমার হার এবং জ্বর ও কাশি কমতে কত দিন লাগে সে সম্পর্কে ধারণা লাভ করা। এ ছাড়া এই গবেষণা অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তার পরিবর্তন, অক্সিজেন দেওয়া সত্ত্বেও রোগী কেন ৮৮ শতাংশের বেশি অক্সিজেন স্যাচুরেশন (এসপিও২) ধরে রাখতে পারে না, রোগীকে অক্সিজেন সরবরাহ ও হাসপাতালে ভর্তি থাকার দিনের সংখ্যায় পরিবর্তন এবং এ রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুর কারণ জানার চেষ্টা করা।

আইসিডিডিআরবির আন্ত্রিক ও শ্বাস-প্রশ্বাস রোগের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং এই গবেষণার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ড. ওয়াসিফ আলী খান বলেন, ‘করোনাভাইরাসের দ্রুত বিস্তারের কারণে আমাদের প্রয়োজন সার্স-সিওভি-২-এর বিরুদ্ধে কার্যকর একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ খুঁজে বের করা। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের কাছে কভিড-১৯-এর চিকিৎসা করার মতো কোনো ওষুধ নেই। এ ধরনের ওষুধ আবিষ্কার হতে কয়েক দশকও লেগে যেতে পারে। তাই আমাদের এমন ওষুধ খুঁজে বের করা প্রয়োজন, যা বাজারে সহজলভ্য, যার ওপর যথেষ্টভাবে গবেষণা করা হয়েছে, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম এবং যা জীবন বাঁচাতে সক্ষম।’

স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্যানেল এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সঙ্গে যুক্ত আছেন। কভিড-১৯ পরীক্ষায় নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত ৪০ থেকে ৬৫ বছর বয়সী আগ্রহী রোগীদের এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যারা মৃদু অসুস্থ এবং সাত দিনের কম সময়ব্যাপী অসুস্থতায় ভুগছেন, এমন রোগীদের এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। গবেষণায় ব্যবহৃত ওষুধ দুটির প্রতি অ্যালার্জি আছে, হৃদরোগ, কিডনি ও লিভারের সমস্যা আছে এবং গর্ভবতী বা বুকের দুধ খাওয়ান এমন মহিলাদের এ গবেষণার আওতায় রাখা হবে না। গবেষণার আওতাভুক্ত একটি দলের রোগীরা এক ডোজ আইভারমেকটিনের সঙ্গে পাঁচ দিনব্যাপী ডক্সিসাইক্লিন পাবেন, অপর একটি দল পাঁচ দিনব্যাপী প্রতিদিন শুধু একটি করে আইভারমেকটিন পাবেন এবং তৃতীয় দল পাঁচ দিনব্যাপী প্রতিদিন একটি করে প্লাসিবো পাবেন। পরীক্ষার ওষুধ ও প্লাসিবোগুলো একইভাবে প্যাকেজ করা হবে এবং গবেষণাধীন ব্যক্তি ও চিকিৎসকরা কেউ জানবেন না কোন রোগী কোন চিকিৎসা পাচ্ছেন।

সম্প্রতি নতুন করোনাভাইরাসের সম্ভাবনাময় চিকিৎসায় আইভারমেকটিনের ব্যবহার মানুষের ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। কভিড-১৯ চিকিৎসায় এটি কেমন কার্যকর তা দেখার জন্য অনেক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। আইভারমেকটিন একটি অত্যন্ত সাশ্রয়ী মূল্যের এবং বেশির ভাগ মানুষের জন্য নিরাপদ বলে বিবেচিত ওষুধ। তবে খুব অল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যে এটি ব্যবহারে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যেমন ত্বকে ফুসকুড়ি ওঠা, বমি বমি ভাব, বমি, ডায়রিয়া, পেটব্যথা, মুখ বা কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফোলা, মাথা ঘোরা, খিঁচুনি, বিভ্রান্তি, রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া ইত্যাদি। এ জন্য রোগীদের শারীরিক, ক্লিনিক্যাল ও গবেষণাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।

সর্বশেষ খবর