রবিবার, ২১ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

ওষুধের বিজ্ঞাপন না থাকায় ভোক্তারা অন্ধকারে

বছরে ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় চিকিৎসকদের পেছনে

বিশেষ প্রতিনিধি

দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধ বিপণন কার্যক্রমের নামে বছরে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ডাক্তারদের পেছনে ব্যয় করলেও ওষুধের গুণগত মান ও কার্যকারিতা নিয়ে কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করছে না। ফলে ওষুধের ক্রেতারা সচেতনতার অভাবে ওষুধ সম্পর্কে অন্ধকারে থাকছেন। কোম্পানি প্রভাবিত ডাক্তারদের ওপরই তাদের শতভাগ নির্ভর করতে হচ্ছে। বিভিন্ন অসুখে মানুষ পুরনো প্রেসক্রিপশন ধরে ওষুধ কিনছেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই সময়ে জনসচেতনতায় ওষুধ কোম্পানিগুলোর কোনো প্রচারণা নেই। অন্য সময়ে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের (এমআর) মাধ্যমে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা শুধু ডাক্তারদের পেছনে ব্যয় করলেও বর্তমানে কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তাদের কোনো ভূমিকা নেই।

দেশে ওষুধ শিল্পের বিজ্ঞাপন প্রচারে সরকারি ঔষধ প্রশাসনের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ফলে কোনো কোম্পানি তার নতুন ওষুধ কিংবা চিকিৎসাপণ্য সম্পর্কে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে জনগণকে জানাতে পারেন না। বিশ্ববাজারে প্রসিদ্ধি পাওয়া বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোকে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে জনসচেতনতায় ভূমিকা রাখার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরকে বিধিমালা সংশোধন করে ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ করে দিতে বলেছেন তারা।

বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) জানিয়েছে, দেশে ওষুধের বিপণন বাবদ মোট টার্নওভারের ২৯ শতাংশের বেশি খরচ করছে কোম্পানিগুলো। দেশে ওষুধের বাজারের আকার এরই মধ্যে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সে হিসাবে শুধু বিপণন বাবদ ওষুধ কোম্পানিগুলো বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করছে। কিন্তু এই বিপণন প্রক্রিয়াটি খুবই অস্বচ্ছ এবং অগ্রহণযোগ্য। ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রধানত ডাক্তারদের উপঢৌকন হিসেবে এই ৬ হাজার কোটি টাকার বেশিরভাগ ব্যয় করে। এজন্য গত তিন-চার দশক ধরে দেশে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ (এমআর) নামে একটি নতুন পেশাজীবী শ্রেণি গড়ে উঠেছে। হাসপাতালের গেটে, ডাক্তারদের চেম্বারের সামনে এসব প্রতিনিধি নিয়মিত জড়ো হন। ডাক্তারদের প্রভাবিত করার মাধ্যমে তারা নিজেদের কোম্পানির ওষুধ লেখান রোগীর প্রেসক্রিপশনে। বিনিময়ে ডাক্তাররা ওষুধ কোম্পানি থেকে পান নানা সুবিধা। প্রকারান্তরে অনেক ডাক্তারই নাকি এখন ওষুধ কোম্পানির বিজ্ঞাপনদাতা। ফলে ওষুধের ক্রেতা জানতে পারছে না ওষুধের গুণাগুণ ও কার্যকারিতা। ক্রেতা থাকছেন অন্ধকারে। অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের কোম্পানির ওষুধও বিপণন কৌশলে ‘বাজার’ পেয়ে যাচ্ছে। ওষুধ শিল্পের উদ্যোক্তারা জানান, সংবাদ মাধ্যমে ওষুধের বিজ্ঞাপন প্রচারে বিধিনিষেধ থাকায় এ কৌশল অবলম্বন করছে তারা। কারণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া প্রচারমাধ্যমে ওষুধের বিজ্ঞাপন প্রচার ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অবস্থায় ওষুধের বিজ্ঞাপন বাবদ বিপুল অঙ্কের এ অর্থ ব্যয় কোথায়, কীভাবে খরচ হয় সে প্রশ্ন উঠছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত ডাক্তারদের তুষ্ট রাখতেই হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ওষুধ কোম্পানিগুলো। শুধু রাজধানীতেই নয় সারা দেশেই এই প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করে ওষুধ কোম্পানিগুলো। ডাক্তারদের নগদ আর্থিক সুবিধা ছাড়াও বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা, বাসায় নতুন ফ্রিজ, টেলিভিশন, এসির ব্যবস্থা করেন। কোনো কোনো ওষুধ কোম্পানি চিকিৎসকদের ফ্ল্যাট-গাড়ির মতো দামি উপহারও দিয়ে থাকে। তারা ওষুধ বিপণনের প্রয়োজনে ডাক্তারদের এসব দিচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি এখন ওপেন সিক্রেট বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত কোম্পানির নিয়োগকৃত মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের (এমআর) মাধ্যমে ডাক্তারদের বাসায় উপহার সামগ্রীটি পৌঁছে দেয় ওষুধ কোম্পানি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ওষুধ বিপণন একটি নিয়মের মধ্যে এলেও দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশে তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। ওষুধ কোম্পানির টাকায় চিকিৎসকদের বিদেশ ভ্রমণ বা উপঢৌকন নেওয়ার মতো অনৈতিক চর্চাগুলো তদারকির মধ্যে নেই। ফলে বিপণন খরচের বড় অংশ অনৈতিকভাবে ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু ওষুধের ভোক্তাশ্রেণি এর মাধ্যমে উপকৃত হতে পারছেন না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর