রবিবার, ২১ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

চীনের শূন্য শুল্কে কতটা লাভবান হবে বাংলাদেশ

চীনের বাজারে আমাদের রপ্তানি অনেকাংশে বেড়ে যাবে : বাণিজ্য সচিব

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

চীনে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ যেটিকে ‘জিরো ট্যারিফ স্কিম’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। জানা গেছে, এ সুবিধা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে দুটি শর্ত মেনে নিতে হয়েছে। এক. বর্তমানে এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (আপটা)-এর আওতায় বাংলাদেশ ৬৫ শতাংশ পণ্যে যে শুল্ক সুবিধা পাচ্ছে চীনে, আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন সুবিধা কার্যকর হলে আপটা সুবিধা অকার্যকর হয়ে যাবে। দুই. আপটার আওতায় চীনে কোনো পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক সুবিধা নিতে হলে বাংলাদেশকে স্থানীয়ভাবে ৩৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন বা ‘ভ্যালু অ্যাড’ করতে হতো, এখন নতুন স্কিমের আওতায় চীনে শূন্য শুল্ক সুবিধা নিতে গেলে আরও ৫ শতাংশ বেশি অর্থাৎ ৪০ শতাংশ হারে ভ্যালু অ্যাড করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ দুই শর্ত দিয়ে চীন যে শূন্য শুল্ক সুবিধা বা জিরো ট্যারিফ স্কিম দিল, তাতে কতটা লাভবান হবে বাংলাদেশ?

লাভ না লোকসান : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, চীনের দেওয়া শর্তের উত্তরে আমরা গত বছর এক চিঠিতে বলেছিলাম, নতুন সুবিধা দিলেও আমাদের আপটা সুবিধা যেন বাতিল করা না হয়। তারা ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ৯৭ শতাংশ পণ্যে শূন্য শুল্ক সুবিধা কার্যকর হলে তখন আর আপটা সুবিধার প্রয়োজন হবে না। ফলে প্রথম শর্তটির কোনো কার্যকারিতা আর থাকছে না। দ্বিতীয় শর্তের ক্ষেত্রে জবাব হচ্ছে, ১০ বছর আগে বাংলাদেশের জন্য এ শর্তটি বাণিজ্যে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটালেও এখন আর কোনো বাধা নয়। কারণ এখন দেশের তৈরি পোশাক, চামড়া, প্লাস্টিক, ওষুধসহ প্রধান প্রধান রপ্তানি পণ্যের শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প দাঁড়িয়ে গেছে। বেশির ভাগ পণ্যে গড়ে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ এমনিতেই ভ্যালু অ্যাড হয়। ফলে স্থানীয় মূল্য সংযোজন ৩৫ না ৪০- তা এখন বাংলাদেশের জন্য কোনো শর্তের মধ্যে পড়ে না। সংশ্লিষ্টদের মতে মূল কথা হচ্ছে, বর্তমানে চীনের বাজারে আপটার আওতায় ৮৩টি পণ্যে এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-এর আওতায় ৪ হাজার ৭৮৮টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। এ দুটি সুবিধায় চীনের ট্যারিফ লাইনের ৬৫ শতাংশ পণ্যে শুল্ক সুবিধা পাওয়া যায়। অথচ এর মধ্যে দেশের প্রধান প্রধান রপ্তানি পণ্যগুলো অন্তর্ভুক্ত নেই। এতে চীনের বাজারে প্রচলিত এ বাণিজ্য সুবিধা বাংলাদেশের কোনো কাজে লাগছে না। এখন ঘোষিত ৯৭ শতাংশ শূন্য শুল্ক সুবিধা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হলে সব মিলিয়ে ৮ হাজারের বেশি পণ্যে শুল্ক সুবিধা পাওয়া যাবে। নতুন সুবিধায় বাংলাদেশ তৈরি পোশাক, চামড়াসহ ১৭টি পণ্যে শুল্ক সুবিধার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। এর উত্তরে চীন বলেছে, তামাক ও ভুট্টা ছাড়া বাকি ১৫টি পণ্যে শুল্ক সুবিধা দিতে তাদের আপত্তি নেই। ফলে প্রাথমিক পণ্য তালিকা বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে, তৈরি পোশাকসহ চীনে রপ্তানিযোগ্য সম্ভাবনাময় সব পণ্যই এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। সে কারণে চীনের দেওয়া নতুন শুল্ক সুবিধার প্রস্তাবটি দেশের জন্য লাভজনক বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। উপরন্তু চীন যে সুবিধা দিতে চাচ্ছে তা কার্যকর হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী বাজার গড়ে উঠবে। কারণ মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ করোনা মহামারীর প্রভাবসহ নানা কারণে চীন থেকে পোশাক খাতসহ পশ্চিমা বিনিয়োগ সরে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের তৈরি পোশাকের মূল্যও বেশি পড়ছে। এ অবস্থায় চীনের নিজেদের জনগণও সস্তায় পণ্য খুঁজছে। এ সুযোগে বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যার এ দেশটির পোশাক খাতের বাজার ধরতে পারলে রপ্তানি বেড়ে যাবে কয়েক গুণ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক, চামড়া, হালকা প্রকৌশল, প্লাস্টিকসহ সম্ভাবনাময় প্রায় সব পণ্যেই এ শূন্য শুল্ক সুবিধা পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। এটি হলে চীনের বাজারে আমাদের রপ্তানি অনেকাংশে বেড়ে যাবে।’ করোনা সংকটে দেশের বিপর্যস্ত রপ্তানি খাতের জন্য এটি বড় ধরনের সুফল বয়ে আনবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি। সচিব আরও জানান, চূড়ান্ত পণ্য তালিকা পাওয়ার পর কীভাবে নতুন সুবিধায় চীনের বাজারে সর্বোচ্চ সুযোগ গ্রহণ করা যায়, তিনি শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সে কৌশল নির্ধারণ করবেন। এজন্য যত ধরনের নীতিসহায়তার প্রয়োজন তাও নিশ্চিত করা হবে বলে জানান সচিব। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে এবং বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণও অনেক। দুই দেশের মধ্যে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যের মধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলারই চীনের রপ্তানি আয়। বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ১ বিলিয়ন ডলারেরও কম। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-এর ভাইস চেয়ারম্যান ও সিইও এ এইচ এম আহসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিগত অর্থবছরে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জীবন্ত মাছ, কাঁকড়া-কুঁচে, ফুল, মসলা, সবজি, তামাক, রাসায়নিক পণ্যসহ প্রায় ৪০০ ধরনের (এইচএসকোড) পণ্য রপ্তানি করেছে চীনে। এর মধ্যে তৈরি পোশাকে ১৪ শতাংশ এবং অন্যান্য পণ্যে ৫-১৭ শতাংশ হারে শুল্ক পরিশোধ করতে হয়েছে। যদিও আপটার আওতায় কিছু কিছু পণ্যে প্রাধিকারমূলক বাণিজ্যসুবিধা পাওয়া গেছে। তবে সেখানে দেশের প্রধান খাতগুলো ছিল না। সে কারণে সম্ভাবনা থাকার পরও দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বাড়েনি। তবে নতুন সুবিধায় সম্ভাবনাময় পণ্য অন্তর্ভুক্ত হলে চীনে দেশের রপ্তানি কয়েক গুণ বেড়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর