রবিবার, ২১ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

কামাল লোহানীর জীবনাবসান

নিজ গ্রামে স্ত্রীর কবরে সমাহিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

কামাল লোহানীর জীবনাবসান

একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষাসৈনিক কামাল লোহানী আর নেই। রাজধানীর মহাখালীতে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সকাল ১০টায় তিনি মারা যান। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬। তিনি এক ছেলে, দুই মেয়েসহ অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী রেখে গেছেন। ২০০৭ সালে তাঁর স্ত্রী দীপ্তি রানী লোহানী মারা যান। কামাল লোহানীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কামাল লোহানীর ছেলে সাগর লোহানী জানান, ১৯ জুন তার বাবার করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। তখন চিকিৎসার্থে তাঁকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করলেও বেড না পাওয়ায় শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সাগর লোহানী বলেন, ‘আগে থেকেই বাবা কিডনি, ফুসফুস ও হার্টের সমস্যায় ভুগছিলেন। তাই ১৭ জুন তাঁকে পান্থপথের হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটলে আইসিইউতে নেওয়া হয়।’

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আনোয়ার তপন জানান, হাসপাতাল থেকে লাশ বেলা ২টায় শেখেরটেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে লাশের গোসল হয়েছে। বিকাল ৩টায় লাশ নেওয়া হয় উদীচী কার্যালয়ে। সেখানে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার খানসোনতলা গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়েছে। আমাদের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, কামাল লোহানীকে রাত ৯টা ৫২ মিনিটে তাঁর স্ত্রী দীপ্তি লোহানীর কবরে দাফন করা হয়। দাফন আয়োজন ও দাফন করা পর্যন্ত কবরস্থানে মরহুমের স্বজনদের সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য তানভীর ইমাম।

সাগর লোহানী জানিয়েছেন, লাশ তার বাবা কোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে দান করার আগ্রহ ব্যক্ত করে গেছেন। কিন্তু তিনি করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ায় পরিবার ‘দান’-এর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। মূলত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর গাইডলাইন না থাকায় লাশ দান করা যাচ্ছে না।

কামাল লোহানীর প্রকৃত নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার খানসোনতলা গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী আর মা রোকেয়া খান লোহানী। কামাল লোহানী পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৫২ সালে। উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে। এরপর তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি ঘটে। পাবনা জিলা স্কুলে শেষ বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন, এতেই ঘটে তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ’৫৩ সালে নুরুল আমিনসহ মুসলিম লীগ নেতাদের পাবনা আগমন প্রতিরোধ করতে গিয়ে তাঁকে কারাগারে যেতে হয়। মুক্ত হতে না হতেই আবার ’৫৪ সালে গ্রেফতার হন কামাল লোহানী। সে সময় তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত হন। পরের বছর আবার গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে একই কারাকক্ষে তাঁর বন্দীজীবন কাটে। যৌবনে তিনি ছিলেন নিপুণ নৃত্যশিল্পী। ’৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে পাকিস্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে ছায়ানটের নেতৃত্বে কামাল লোহানী ও হাজারো রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মী সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ’৬২ সালে নির্বাচিত হন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক। ’৬৭ সালে গড়ে তোলেন তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’। ষাটের দশকের শেষ ভাগে ন্যাপের (ভাসানী) রাজনীতিতে জড়িয়ে কামাল লোহানী যোগ দেন আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে পূর্ব বাংলার শিল্পীরা যে ভূমিকা রেখেছেন, তার সঙ্গেও কামাল লোহানী সম্পৃক্ত ছিলেন পুরোপুরি। ’৭১ সালে বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে কামাল লোহানী তাতে যোগ দেন। সে সময় তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁকে বাংলাদেশ বেতারের পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন কামাল লোহানী। ’৮১ সালে দৈনিক বার্তার সম্পাদক পদে ইস্তফা দিয়ে নতুন উদ্যমে সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগঠিত করার কাজ মনোনিবেশ করেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠনেও ছিল তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কামাল লোহানীর সাংবাদিকতার সূচনা দৈনিক মিল্লাতে। সাংবাদিকতা জীবনে তিনি আজাদ, সংবাদ, পূর্বদেশ, বঙ্গবার্তা, বাংলার বাণী ও দৈনিক প্রভাতে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন। স্বাধীনতার আগে তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নে দুই দফা যুগ্মসম্পাদক হন। স্বাধীনতার পর নির্বাচিত হন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য ২০১৫ সালে সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ২০১৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখায় বাংলাদেশ প্রতিদিন আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে আজীবন সম্মাননায় সম্মানিত করে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির দুবার মহাপরিচালক ও ছায়ানটের সম্পাদক হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেন কামাল লোহানী। মৃত্যুর সময় তিনি উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা পদে ছিলেন।

বিশিষ্টজনদের শোক : এ ছাড়া শোক জানিয়েছেন জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ, স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া ও চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ, পরিবেশ, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ও প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।

এ ছাড়া শোক জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের মহাসচিব মো. মসিউর রহমান রাঙ্গা, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল) সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম, সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, বিএফইউজে সভাপতি মোল্লা জালাল, মহাসচিব শাবান মাহমুদ, ডিইউজে সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান এম এ আউয়াল, গণদল চেয়ারম্যান এ টি এম গোলাম মাওলা চৌধুরী, মহাসচিব আবু সৈয়দ, বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজি) ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার), সংস্কৃতি সচিব ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল এনডিসি, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, এনএফএস সভাপতি রাহাত হুসাইন, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী, গণসংগীত শিল্পী পরিষদ, ঢাকাস্থ রাজশাহী বিভাগ সাংবাদিক সমিতি, নতুন কথা, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর