মঙ্গলবার, ২৩ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

জনবিচ্ছিন্ন হয়ে আমলাতন্ত্র নির্ভরতা হবে আত্মঘাতী

ড. হারুন-অর-রশিদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. হারুন-অর-রশিদ বলেছেন, গণমানুষের দল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ মানেই জনগণের দল। জনভিত্তি ছিল বলেই ৭১ বছরে এসেও সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ভবিষ্যতেও জনগণ হবে এই দলটির মূল শক্তি। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো আমলাতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনতন্ত্রের ওপর নির্ভর হয়ে পড়া হবে দলটির জন্য আত্মঘাতী। আমলাতন্ত্র ও প্রশাসনতন্ত্র থাকবে রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য। জনগণই আওয়ামী লীগের আশ্রয়স্থল। আমলাতন্ত্র বা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনতন্ত্র নয়। কথাটি আওয়ামী লীগকে মনে রাখতে হবে। জনগণের দল জনগণের মধ্যেই থাকতে হবে। আওয়ামী লীগকে নিজস্ব ধারায় চলমান রাখাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন এই দলে ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে চাওয়া-পাওয়া কী জানতে চাইলে তিনি এ কথা বলেন।   

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. হারুন-উর-রশিদ বলেন, দেশে অনেক বড় বড় রাজনৈতিক দল ছিল। কিন্তু জনভিত্তি ও জনসম্পৃক্ততা না থাকায় সেসব দলের এখন অস্তিত্ব নেই। এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের জনসম্পৃক্ততা ছিল বলেই এখনো সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। এই জনসম্পৃক্ততা ধরে রাখতে হবে। জনগণের কাছেই যেতে হবে। এ বিষয়টার দিকে আওয়ামী লীগকে দৃষ্টি রাখতে হবে। জনগণের দল আওয়ামী লীগ জনগণের মধ্যেই থাকতে হবে। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমলাতন্ত্র, প্রশাসনযন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে দেশ বা রাষ্ট্র পরিচালনা করে টিকে থাকার চেষ্টা করা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আশা করি, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা করবেন না।   

তিনি বলেন, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন এই দলটি জন্মগ্রহণ করে। বিগত ৭১ বছর আওয়ামী লীগ জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশের জনগণকে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। ৭১ বছরের এই আওয়ামী লীগের পথচলা সংগ্রাম, গৌরবের, সৃষ্টি, অর্জন উন্নয়নের ইতিহাস। সরকারি দল কিংবা বিরোধী দলে সব সময় জনগণের জন্য, দেশের কল্যাণে সব সময় কাজ করেছে। আজকে পয়লা বৈশাখ পালন করা হয় সেটা হয়েছে ১৯৫৬-১৯৫৮ সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আমলেই। একুশে ফেব্রুয়ারি ছুটি পালন করা হয়, সেটাও আওয়ামী লীগের হাত ধরে। এখন যে বাংলা একাডেমি সেটা আগে ছিল বর্ধমান হাউস। পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রথমে সেখানে বাংলা চর্চা হতো। পরে বাংলা একাডেমিও হয়েছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে। এভাবে দেখা যায়, দেশের প্রতিটি অর্জনই আওয়ামী লীগের হাত ধরে। যমুনা নদীতে সেতু করতে আওয়ামী লীগ ১৯৬৪ সালের জাতীয় কাউন্সিলের রেজুলেশন করেছিল। আজ বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু বাস্তব। স্বাধীনতা-পরবর্তী আমরা মাত্র ১০ মাসে একটি সুন্দর সংবিধান পেলাম। বঙ্গবন্ধু অনেক আইন করেছেন, প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। জাতির পিতা যখন দেশ গড়ার কাজ করছেন তখন মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় পরাজিত শক্তির দোসররা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য হারুন-অর-রশিদ আরও বলেন, এরপর ১৯৭৫-১৯৯০ সাল পর্যন্ত জেনারেল জিয়াউর রহমান ও এরশাদের নেতৃত্বে দেশে পাকিস্তানি ধারার রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তন ঘটল। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে ১৭ মে নির্বাসিত জীবন শেষে দেশে ফিরে আসেন। এরপর মানুষের ভোট ও ভাতের সংগ্রামে নেমে পড়েন। তিনি দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম ছুটে বেড়ান। দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেন। সে সময় দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে অশান্তি বিরাজ করছিল, সেখানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই হয়েছে।

এরপর ২০০১-০৬ সাল বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় থাকে। এরপর আসে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারা বিরাজনীতিকরণ করতে চেয়েছিল। মূলত শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। সে সময়ে এ দেশের রাজনীতিবিদ, ছাত্র, শিক্ষক, সবাই সংগ্রাম করেন। আমি নিজেসহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক, ছাত্র গ্রেফতার হয়। তীব্র আন্দোলনের মুখে পড়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাধ্য হয় ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন দিতে। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দেশের জনগণের ম্যান্ডেট পায়। এরপর তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ একটানা ক্ষমতায়। টানা ক্ষমতায় থাকার ফলে দেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন আজ বিস্ময়কর উত্থান। বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ। বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল, তখন নিজস্ব অর্থায়নে আজকে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। কর্ণফুলী টানেল হচ্ছে। বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার সমস্যা সমাধান হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ হয়েছে না?

রাজনৈতিক এই বিশ্লেষক বলেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার দায়িত্ব আওয়ামী লীগের ওপরই পড়ে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে রক্তের উত্তরাধিকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার আদর্শ বাস্তবায়ন করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব না থাকলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও যুদ্ধাপরাধীর বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হতো না। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। দেশের মানুষের প্রত্যাশা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে জনগণের কাজ করছে।

আওয়ামী লীগের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে হবে। সব প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। জঙ্গিবাদ-সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির দেশ। এই সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি যারা নষ্ট করতে চায় তাদেরকে নিমূর্ল করতে হবে। আরেকটি চ্যালেঞ্জ কোনোভাবেই জনগণ থেকে বিচ্যুত হয়ে আমলা নির্ভর ও প্রশাসন নির্ভর হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে টিকে থাকার চেষ্টা করা যাবে না।

সর্বশেষ খবর