বুধবার, ২৪ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সংকট

মাহবুব মমতাজী

দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হিসাবে ঢাকার পরই রয়েছে চট্টগ্রাম। কিন্তু এই দুই শহরে বিপুল সংখ্যক রোগীর জন্য যে পরিমাণ চিকিৎসাসেবা থাকা প্রয়োজন, সেটি নেই বলে অভিযোগ উঠেছে। করোনাভাইরাস পজিটিভ রোগী বা ভাইরাসের লক্ষণ নিয়ে আসা রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কোনোভাবে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারলেও তারা পাচ্ছেন না জরুরি সেবা।

জানা যায়, চট্টগ্রামের বাসিন্দা জোবায়ের চৌধুরী তার ৬২ বছর বয়সী বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘোরেন। এক পর্যায়ে চিকিৎসা ছাড়াই তার বাবা ধুঁকে ধুঁকে মারা যান। কয়েক দিন ধরে তীব্র ঘাড়ব্যথায় ভুগছিলেন তার বাবা। পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকলে ১০ জুন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আগে থেকে ফোন করে গেলেও হাসপাতালে গিয়ে জোবায়ের দেখতে পান জরুরি বিভাগে কোনো চিকিৎসক নেই। কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈশ্বিক মহামারী করোনার থাবায় দিন দিন বাড়ছে আক্রা?ন্তের সংখ্যা। এসব রোগী?কে চি?কিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হ?চ্ছেন চিকিৎসকরাও। এ আতঙ্কে হাসপাতালে আগের তুলনায় কম সময় দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের (বিডিএফ) দেওয়া তথ্যে জানা যায়, এ পর্যন্ত সারা দেশে ১ হাজার ৩৪০ জন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৮৩৯ জন। একদিকে যেমন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালগুলো ঠিকভাবে সেবা দিতে পারছে না, অন্যদিকে অন্যান্য জটিলতার রোগীরাও চিকিৎসা পেতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি সেই তালিকায় রয়েছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোও। স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা নিয়ে বরাবর অভিযোগ থাকলেও করোনাভাইরাস সংক্রমণ বিস্তার লাভের পর থেকেই সারা দেশের স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা যে কতটা নাজুক, সেই চিত্র ফুটে উঠেছে। সম্প্রতি মারা যাওয়া একজন অতিরিক্ত সচিবের চিকিৎসক-তনয়া সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, কিডনির সমস্যা নিয়েও একের পর এক হাসপাতাল ঘুরে তার বাবাকে ভর্তি করাতে পারেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত তারা বিফল হয়ে রোগীকে নিয়ে বাসায় এসে একজনের তদবিরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারেন। কিন্তু আইসিইউ সুবিধা না পাওয়ার কারণে তার বাবা মারা যান। তবে জেলা বা উপজেলা শহরে চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতার অভিযোগ বেশ পুরনো। সেখানে ভালো চিকিৎসক থাকেন না। হাসপাতালগুলোয় সরঞ্জামাদির অভাবের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এখন ঢাকা ও জেলা শহরগুলোর হাসপাতালগুলোতেও চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ানের অভাব, আইসিইউ ও মেডিকেল সরঞ্জামের অপর্যাপ্ততার নানা চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশজুড়ে যে হাজার হাজার বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক গড়ে উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে এ সংকটের সময় চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে রাখার অভিযোগও রয়েছে।

সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিযোগ, তাদেরও অনেক প্রতিকূলতা এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। মানসম্পন্ন মাস্ক ও পিপিই না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে করোনাভাইরাস সংকটের শুরু থেকেই।

এর আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল হাসান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, চিকিৎসা সংকট নিরসনের জন্য তারা হাসপাতালের শয্যা ও আইসিইউ বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ তারা নেননি। এ বিষয়ে জানতে গতকাল একাধিকবার তার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা ডা. মুজাহারুল হক এ প্রতিবেদককে বলেন, জরুরি ভিত্তিতে আইসোলেশন সেন্টার বাড়াতে হবে। আর সেখানে অক্সিজেন ক্যানোলা ও মাস্কের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ছাড়া আইসিইউ বেড এবং ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে ফিল্ড হাসপাতাল কিংবা মেটশিট হাসপাতাল বাড়াতে হবে। নিয়োগ দিয়ে চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ ছাড়া উপজেলা হাসপাতালগুলোর আইসোলেশন বেডগুলোকে কাজে লাগাতে হবে এবং জেলা হাসপাতালে বেড ও আইসিইউ বেড বাড়াতে হবে। করোনা মোকাবিলার জন্য সব বেসরকারি হাসপাতালকে জাতীয় পর্যায়ে সম্পৃক্ত করতে হবে। সরকার কিংবা স্বাস্থ্য অধিদফতরের সদিচ্ছা থাকলে এসব পদক্ষেপ আগেই বাস্তবায়ন করতে পারত। জানা গেছে, সারা দেশে ৬৫৪টি হাসপাতাল ও ২৫ হাজার চিকিৎসক নিয়ে সরকারি হাসপাতালগুলো লড়াই করছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে। এসব হাসপাতালে বেড আছে ৫১ হাজার ৩১৬টি। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিত্র ঠিক উল্টো। দেশে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক আছে ৫ হাজার ৫৫টি। এসব হাসপাতালে নিয়োজিত আছেন প্রায় ৬০ হাজার চিকিৎসক। হাসপাতালগুলোতে বেড সংখ্যা ৯০ হাজার ৫৮৭টি। জেলা শহরের অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ। রাজধানীর অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালের বেড খালি। সেখানে এখন তেমন কোনো রোগী নেই।

সর্বশেষ খবর