বুধবার, ২৪ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

ভালো নেই ডাক্তাররাও মৃত্যু অর্ধশতাধিক

গোলাম রাব্বানী

একজন ডাক্তার দায়িত্ব পালন করেন চাঁদপুরে। তার পরিবার থাকেন চট্টগ্রামে। হঠাৎ পরিবারের ছয়জন সদস্যের করোনা উপসর্গ দেখা দেয়। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করেও তিনি পরিবারের সদস্যদের করোনা টেস্ট করাতে পারেননি। টেস্ট ছাড়াই তাদের বাড়িতে আলাদা রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্ব পালন করেন একজন ডাক্তার। তার পরিবার থাকেন ঢাকায়। তিনি থাকেন নিজ কর্মস্থলে। ডাক্তার হিসেবে নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে। তিনি বলেন, ডাক্তাররা ভালো নেই। আমাদের দেখার কেউ নেই। করোনাকালে নিরাপত্তা নিয়ে বেশি চিন্তায় আছি। ডাক্তাররা মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারা অসুস্থ হলে কোথায় চিকিৎসা নেবেন, সেই ব্যবস্থা নেই। আমরা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকতে পারি না। তারা অসুস্থ হলে কোথায় নিয়ে চিকিৎসা করাব  তা নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তায় থাকি। তিনি বলেন, উপজেলা হাসপাতালে পিপিই পাওয়া যায়। তবে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যান্ড গ্লাভসসহ অন্যান্য নিরাপত্তা সামগ্রী তেমন পাওয়া যায় না। নিজের টাকায় সব কিনতে হয়।

একজন তরুণ ডাক্তার। মাসে ১২-১৫ হাজার টাকার চাকরি করেন ক্লিনিকে। কিন্তু দুই মাস থেকে বেতন পান না। এখন তার সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। তবুও এই বেতন, করোনার ঝুঁকি নিয়ে, জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

সম্প্রতি চট্টগ্রামে একজন ডাক্তার জ্বর নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছিলেন। ওই হাসপাতালে রিজার্ভ ডাক্তার না থাকায় তাকে জ্বর নিয়ে চিকিৎসাসেবা দিতে হয়েছে। পরে তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। একজন নারী ডাক্তার। চাকরি করেন একটি বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু তিনি মাতৃকালীন ছুটিও পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, নির্দেশনা রয়েছে গর্ভবতী বা অসুস্থ ডাক্তারদের হাসপাতালে ডিউটি থেকে বিরত রাখতে হবে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি হাসপাতলে সেই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। অনেক গর্ভবতী ও অসুস্থ ডাক্তারকে ডিউটি করানো হচ্ছে। ডাক্তার বলেই কি আমাদের অসুস্থতা থাকতে পারে না? আমরা কি ছুটি পাব না? সিলেটের একজন ডাক্তার বলেন, ডাক্তারদের সমস্যার শেষ নেই। পর্যাপ্ত পিপিই নেই। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সামগ্রী নেই। সিলেটে একজন ডাক্তার রোগী দেখতে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেন। বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তার অবস্থার অবনতি হলো, প্রয়োজন আইসিইউ বেড। বিভাগীয় শহর সিলেটে তা পাওয়া গেল না। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকায় গেলেন। পরে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। এ তো গেলে মাত্র কয়েকজন ডাক্তারের কথা। দেশের ডাক্তাররা কমবেশি সবাই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। তারা ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। অনেক সময় মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছেন। এমনকি কভিড-১৯ মহামারীতে দেশের চিকিৎসকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যখন একের পর এক মারা যাচ্ছেন, এমন সময়ে খুলনায় বেসরকারি ক্লিনিকের এক চিকিৎসককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়াও করোনাকালে নানা সামাজিক বঞ্চনার শিকারও হচ্ছেন দেশের চিকিৎসকরা। বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চাকরি হারাচ্ছেন ডাক্তাররা। বেতনটাও ঠিকমতো পাচ্ছেন না। এত দিনেও ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য চিকিৎসার সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা হয়নি। করোনাকালে দায়িত্ব পালনকালেও তাদের বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না। বেসরকারি হাসপাতালে মালিক ও প্রশাসনের কাছে অনেকটাই জিম্মি তারা। তৃণমূলেও রয়েছে হতাশা ও ক্ষোভ। করোনাকালে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে অনেক চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেছে। করোনাকালে সব ডাক্তার চিন্তায় আছেন নিজের নিরাপত্তা নিয়ে। তাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সামগ্রী নেই। ডাক্তাররা বলেছেন, আমরা সবার চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি। কিন্তু ডাক্তারদের নিজেদের চিকিৎসাসেবার কোনো ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালগুলোতে রিজার্ভ ডাক্তার নেই। একজন ডাক্তার অসুস্থ হলে তার দায়িত্ব কে পালন করবেন? তা নিয়ে চিন্তায় থাকতে হয় ডাক্তারদের। এ ছাড়া করোনাকালে ডাক্তারের জ্বর হলে বা অন্য কোনো অসুস্থতা থাকলেও ১০ দিনের বেশি ছুটি পান না তারা। ১০ দিনের মধ্যে হাসপাতালে ডিউটি শুরু করতে হয়। এ ক্ষেত্রে পুরাপুরি সুস্থ না হলেও অনেক ডাক্তারকে হাসপাতালে রোগী দেখতে হচ্ছে। এজন্য জনস্বাস্থ্য হুমকিতে পড়ছে। কারণ ডাক্তার যদি সুস্থ না থাকেন তিনি কীভাবে রোগীর সেবা দেবেন। আবার অসুস্থ ডাক্তারের মাধ্যমে রোগ ছড়াতে পারে। এ ছাড়া করোনাকালে ডাক্তাররা সামাজিকভাবে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। ডাক্তার শুনলে অনেকেই বাসা ভাড়াও দিচ্ছেন না। চেম্বার বন্ধ থাকায় অনেক ডাক্তার আর্থিক সংকটেও পড়েছেন। ছেলেমেয়ে পড়া লেখা তথা স্কুলের টাকা দেওয়া নিয়ে চিন্তায় আছেন অনেকেই। আর আর্থিক সংকটের কারণে ডাক্তারদের মানসিক চাপও দিন দিন বাড়ছে। আবার নিজের টাকা দিয়ে নিরাপত্তা সামগ্রী তথা মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যান্ড গ্লাভসসহ অন্যান্য নিরাপত্তা সামগ্রী কিনতে হচ্ছে। চট্টগ্রামের একজন চিকিৎসক বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে প্রশাসনের সঙ্গে রোগীর সেবা নিয়ে কথা বললে চাকরি হারাতে হয়। আমরা প্রশাসনের কাছে একপ্রকার জিম্মি। অনেকের বেতন বন্ধ। অনেক ডাক্তারকে অর্ধেক বেতন দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আসলে ডাক্তাররা করোনাকালে ভালো নেই।     

করোনাকালে অর্ধশতাধিক চিকিৎসকের মৃত্যু : চিকিৎসকদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ নিয়মিতভাবে বেড়ে চলছে। মৃত্যুর মিছিলও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। মারা গেছেন অন্তত অর্ধশতাধিক চিকিৎসক। এমন খবরে রীতিমতো উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন মোট ৪৬ জন চিকিৎসক। আর করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে ৮ জন চিকিৎসকের। এ পর্যন্ত সারা দেশে এক হাজার ৩২২ জন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৮২৭ জন চিকিৎসক। এসব তথ্য বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের (বিডিএফ)।

সর্বশেষ খবর