শিরোনাম
শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

ভয়াবহ ঝুঁকিতে অন্য রোগীরা

সংক্রমণের ভয় হাসপাতালে, অনেক চিকিৎসকই রোগী দেখছেন না

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ভয়াবহ ঝুঁকিতে অন্য রোগীরা

করোনার চিকিৎসা তো মিলছেই না। অন্য রোগীদের অবস্থা আরও ভয়াবহ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

তিন বছর ধরে কিডনি সমস্যায় ভুগছেন রাজধানীর সবুজবাগের বাসিন্দা মেহেরুন্নেসা আক্তার। সপ্তাহে দুবার ডায়ালাইসিস করতে হয়। এ ছাড়া নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে থাকতে হয় তাকে। মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতেন। ওই হাসপাতালকে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারণ করায় কোথায় ডায়ালাইসিস করাবেন এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে তার পরিবার।

শুধু মেহেরুন্নেসা নন, ক্যান্সার, লিভারের সমস্যা, কিডনি সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের রোগীরা ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন। নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শে তাদের চিকিৎসা চললেও করোনার কারণে তা বিঘ্ন ঘটছে। অনেক চিকিৎসকই রোগী দেখছেন না। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে তারা হাসপাতালে যেতেও পারছেন না। অন্য রোগীদের তুলনায় সংক্রমিত হলে এ ধরনের রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। অনেকে অসুস্থতা চেপে অপেক্ষা করছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার। শারীরিক জটিলতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা আতঙ্ক। অন্য সময় হাসপাতালে নির্ধারিত শয্যার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি থাকলেও এখন পুরোপুরি বিপরীত চিত্র। সাধারণ সময়ে যেসব হাসপাতালে ভর্তির জন্য অপেক্ষা করতে হতো, এখন সেখানে ফাঁকা পড়ে থাকছে। দেশের বড় বড় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের সর্বত্রই প্রায় একই চিত্র। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোগী ও চিকিৎসক সবার মধ্যেই থাকা করোনা আতঙ্কেই হাসপাতালগুলোর এ পরিস্থিতি। কারণ অনেক হাসপাতালে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট থাকলেও রোগীই নেওয়া হচ্ছে না। আর বেশির ভাগ হাসপাতালে করোনা নেই এমন সার্টিফিকেট ছাড়া সাধারণ রোগের রোগীদেরও ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না। চিকিৎসা সেবাই নয়, চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সাধারণ টেস্টগুলোও প্রায় বন্ধের উপক্রম। ভিড় শুধু করোনা হাসপাতালগুলোয়।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘হাসপাতালগুলোয় আগে রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতো হতো। অথচ এখন প্রায় রোগীশূন্য। লকডাউনের কারণে রোগীরা আসতে পারছেন না আবার এলে প্রয়োজনীয় সেবাও অনেক সময় পাচ্ছেন না। হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে রোগী মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। করোনার কারণে অনেক সময় চিকিৎসকরাও ভয় পাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছেন হার্ট, কিডনি রোগীরা।’ জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) শয্যা রয়েছে ১ হাজার ৯০৪টি। বর্তমানে হাসপাতালটির ইনডোর-আউটডোর দুই বিভাগেই আগের তুলনায় প্রায় ৪৫ শতাংশ রোগী কম। শুধু সরকারি হাসপাতাল নয়, ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর একই চিত্র। রাজধানীর পান্থপথে অবস্থিত স্কয়ার হাসপাতালে ৪০০ শয্যা রয়েছে। বর্তমানে মাত্র ১৫০ জন রোগী ভর্তি আছেন। ফাঁকা রয়েছে ২৫০ শয্যা। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল গনি মোল্লা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাধারণত আমাদের হাসপাতালের আউটডোরের দুই ইউনিটে ৬-৭ হাজার রোগী আসতেন প্রতিদিন। এখন আউটডোরে গড়ে ১২০ জনের মতো আসেন। ভর্তি রোগী থাকেন ৬০০-এর মতো। বর্তমানে রয়েছেন ৩৫০ জন। এ ছাড়া প্রতিদিন ২০-২৫ জন রোগী আসেন দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রেফার্ড হয়ে।’ তিনি আরও বলেন, ‘করোনার কারণে আমাদের সেবায় কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। সন্দেহভাজন রোগীদের জন্য আইসোলেশন ওয়ার্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া সন্দেহ হলে আমরা করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করছি। আমাদের এখানে দুর্ঘটনায় আহত জরুরি রোগীরা আসছেন। জরুরি বিভাগে ২৪ ঘণ্টা সেবা কার্যক্রম চলছে।’ করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে অধিকাংশ হাসপাতালের স্বাভাবিক সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। জরুরি রোগীদের সেবা পেতে পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি। করোনা টেস্ট ছাড়া অন্য কোনো টেস্টের জন্য নেই দৌড়ঝাঁপ। অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টারই বন্ধ। অল্প কিছু খোলা থাকলেও রোগী আসছেন না টেস্ট করানোর জন্য। হাসপাতাল করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা। এজন্য সাধারণ সমস্যায় রোগীরা আসছেন না। কিন্তু একান্ত প্রয়োজনে এলেও মিলছে না সেবা। আট মাস ধরে ফুসফুস ক্যান্সারে ভুগছেন সাভারের বাসিন্দা নওশের আলী। আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার পর ভারতে চিকিৎসা করাতেন। তার থেরাপিও শুরু হয়েছিল। এখন সব বন্ধ। তার ছেলে শফিক আলী বলেন, ‘বাবার ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার পর ভারতে চিকিৎসা শুরু হয়েছিল। একটা কেমোথেরাপি দেওয়ার পর করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। পরে দেশেই থেরাপির আরেক ধাপ দেওয়া হয়। কিন্তু করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় থেরাপি দেওয়ার জন্য কোন হাসপাতালে নিলে ভালো হয় তা বুঝতে পারছি না। এ রকম রোগী যদি করোনা আক্রান্ত হন তাহলে ঝুঁকি সর্বোচ্চ। তাই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ারও সাহস পাচ্ছি না।’ বিপাকে পড়েছেন ডায়াবেটিস আক্রান্তরাও। করোনার কারণে হাসপাতালে নিয়মিত ডাক্তার দেখাতে পারছেন না। এমনকি বাইরে অনেকে হাঁটতেও যাচ্ছেন না। শারীরিক জটিলতার কারণে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে আতঙ্কে রয়েছেন এ ধরনের রোগীরা। তবে চিকিৎসকরা আতঙ্কিত না হয়ে বাড়িতে নিয়মিত শারীরিক কসরত ও সচেতন থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর