শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

গণপরিবহনে ভাড়া আদায়ে স্বেচ্ছাচার

নিজামুল হক বিপুল

গণপরিবহনে ভাড়া আদায়ে স্বেচ্ছাচার

করোনা পরিস্থিতিতে গণপরিবহনের ভাড়া নৈরাজ্য আরও বেড়েছে। রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে গতকাল তোলা ছবি -জয়ীতা রায়

ঢাকার গাবতলী থেকে যশোরের মনিহার পর্যন্ত দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার। গণপরিবহনে এই দূরত্বের ভাড়া ২৮০ টাকা। করোনার কারণে সরকার পরিবহন ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়িয়েছে। তাই, এই দূরত্বে একজন যাত্রীর কাছ থেকে ভাড়া আদায় করার কথা (ফেরি ভাড়াসহ) ৫০০ টাকা। আদায় করা হচ্ছে ৯০০ টাকা করে। এই দূরত্বে আগে যখন ভাড়া ২৮০ টাকা ছিল তখন নেওয়া হতো জনপ্রতি ৪৫০ টাকা।

ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী পর্যন্ত দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। সরকার কর্তৃক বর্ধিত হারে প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ২৭ পয়সা করে জনপ্রতি ভাড়া আদায়ের কথা ৩৪০ টাকা ৫০ পয়সা। সেখানে যাত্রীপ্রতি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ৬০০ টাকা। প্রায় দ্বিগুণ। এই রুটেও আগে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ছিল ২৫০ টাকা কিন্তু আদায় করা হতো ৩২০ টাকা।

একই অবস্থা ঢাকা-মৌলভীবাজার রুটে। সায়েদাবাদ থেকে মৌলভীবাজারের দূরত্ব মাত্র ২০৮ কিলোমিটার। ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির কারণে যাত্রীপ্রতি গণপরিবহনের ভাড়া আদায় করার কথা ৪৭৫ টাকা। কিন্তু নেওয়া হচ্ছে ৭৬০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। আর রাজধানী ঢাকার অবস্থা আরও খারাপ। নগর পরিবহনগুলো ইচ্ছামতো যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করছে। সাত-আট কিলোমিটার দূরত্বে যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে ৩০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত। গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের নির্দেশনার পরোয়া করছেন না পরিবহন মালিকরা। তারা নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছেন। যদিও করোনা পরিস্থিতির কারণে সারা দেশেই গণপরিবহনগুলোতে যাত্রীর সংখ্যা এখনো অনেক কম। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার গত ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। দফায় দফায় বাড়িয়ে এই ছুটির মেয়াদ ৩০ মে পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর সারা দেশে ট্রেন, বাস, লঞ্চসহ সব ধরনের গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। মূলত সংক্রমণ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সে জন্য সরকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সাধারণ ছুটির পাশাপাশি গণপরিবহন বন্ধ করে।

ছুটি শেষে সরকার গত ৩১ মে থেকে সারা দেশে সীমিত পরিসরে অফিস, আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, শপিং মল, শিল্প-কারখানা, বাস, ট্রেন, লঞ্চসহ সব ধরনের গণপরিবহন খুলে দেয়। গণপরিবহন চালুর ক্ষেত্রে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর জন্য সরকারকে আহ্বান জানায়। সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ৩১ মে পরিবহন মালিক, শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ৮০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর সুপারিশ করে। ওই দিনই এই সুপারিশ পাঠিয়ে দেওয়া হয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত সুপারিশ মূল্যায়ন করে ২০ শতাংশ কমিয়ে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন দেয় এবং ওই দিনই প্রজ্ঞাপন জারি করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। এরপর ১ জুন থেকে শুরু হয় গণপরিবহন চলাচল। করোনাভাইরাসে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ২১৫টি দেশ আক্রান্ত হয়েছে। অধিকাংশ দেশ ধীরে ধীরে তাদের লকডাউন তুলে নেয় এবং নিচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের কোনো দেশই বর্তমান পরিস্থিতিতে গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি করেনি। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। পরিবহন মালিকদের দাবির মুখে সরকার গাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি করে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দিলেও সরকারের সিদ্ধান্ত মানছেন না পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। এই পরিস্থিতিতে যাত্রীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কাছে। জানা গেছে, ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণাঞ্চল, খুলনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভীবাজার, নোয়াখালী, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, বগুড়া, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, জামালপুরসহ সারা দেশে যাত্রীবাহী যেসব গণপরিবহন চলছে তার সবগুলোতেই যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে দ্বিগুণ। বেশি ভাড়া আদায় করছে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী শ্যামলী পরিবহন, হানিফ পরিবহন, এনা পরিবহন, সেন্টমার্টিন এক্সপ্রেস, ইউনিক গোল্ডেন, এসপি গোল্ডেন, সৌখিন পরিবহন, পূর্বাশা, কে লাইন, এসআর পরিবহনসহ আরও অনেক পরিবহন।  

একইভাবে রাজধানীতে চলাচলকারী গণপরিবহনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। উত্তর বাড্ডা থেকে সায়েদাবাদের দূরত্ব হচ্ছে ৭ দশমিক ০৮ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত ভাড়া জনপ্রতি ১৮ টাকা ১৬ পযসা। কিন্তু ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৩০ টাকা। পল্টন থেকে গাবতলী দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। এখানে ভাড়া হলো যাত্রীপ্রতি ৩০ টাকা। অথচ পরিবহন ভেদে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৪০ টাকা। এভাবে রাজধানীর প্রতিটি সড়কেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। নগরীতে চলাচলকারী মৌমিতা পরিবহন, ঠিকানা পরিবহন, ওয়েলকাম, বলাকা পরিবহন, আকাশ, তুরাগ ৮ নম্বর, ১২ নম্বরসহ সব পরিবহন। আর যেসব পরিবহন পাটুরিয়া-গুলিস্তান রুটে যাতায়াত করে সেগুলো গাবতলী থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ভাড়া নেয় ৬০ টাকা করে। এই রুটে চলাচলকারী পরিবহনের মধ্যে রয়েছে ডি-লিংক, সেবা পরিবহন, হিমাচল, নীলাচল পরিবহনসহ আরও বেশ কিছু পরিবহন।

পরিবহনগুলোর অতিরিক্ত ভাড়া তোলা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ৫২ সিটের গাড়িকে ৪০ সিট করায় ভাড়াটা সমন্বয় করা হয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, কেউ যদি অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে থাকে তাহলে সরকার তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিক। আমরা তো শুরুতেই বলেছি, কেউ বেশি ভাড়া নিলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি দিক। এনায়েত উল্লাহ বলেন, সারা দেশে লকডাউন চলছে। এমনিতেই যাত্রী নেই। ৩০ শতাংশ গাড়ি চলছে। আমরা সবাইকে বলে দিয়েছি অতিরিক্ত ভাড়া না নেওয়ার জন্য। তারপরও কেউ নিলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মালিক সমিতির পক্ষে তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে এটা মনিটরিং করা যাবে না। সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি হানিফ খোকন বলেন, বিশ্বের দুই শ’র বেশি দেশ করোনা আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু কোনো দেশই গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি করেনি। আমাদের বিআরটিএ বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনা না করে ৮০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর সুপারিশ করে। পরে মন্ত্রণালয় সেটিকে ৬০ শতাংশ করেছে। এখন এটাও পরিবহন মালিকরা মানছেন না। তারা সরকারি আদেশকে অবজ্ঞা করে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত ভাড়া আদায়কারী মালিকদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে মানুষকে দুর্ভোগের হাত থেকে রক্ষা করবে। এ ব্যাপারে জানতে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

সর্বশেষ খবর