শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা
শ্রদ্ধাঞ্জলি

মাশুক চৌধুরী কবিদের কবি

মোহন রায়হান

মাশুক চৌধুরী কবিদের কবি

স্বপ্নভঙ্গের হতাশা বেদনা ক্ষোভই প্রধান হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সাহিত্যে। যে সব কবি-সাহিত্যিক সেই সময়কে ধারণ করে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন কবি মাশুক চৌধুরী তাঁদের অন্যতম। কিন্তু মাশুক চৌধুরীর সঙ্গে অন্য কবিদের পার্থক্য ছিল এই যে, তাঁর কবিতা ছিল তাঁর স্বভাবের মতোই মৃদুভাষী অথচ প্রচ- আত্মপ্রত্যয়ী। তাঁর প্রচ- প্রবল দ্রোহ বা প্রতিবাদের কিংবা বিপ্লবের খুনমাখা কবিতাও মর্মস্পর্শী প্রেমের কবিতার মতো স্নিগ্ধ-

কবি যদি বলে তবে সূর্য থেমে যাবে ঠিক

মধ্যরাতের মধ্যগগনে।

কবি যদি বলে তবে এক্ষুনি

কাঁচের মতন শব্দ করে সমস্ত আকাশ ভেঙ্গে যাবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র হিসেবে বাংলা ভাষা সাহিত্যের ক্রমবিকাশের ইতিহাসই শুধু অবগত ছিলেন না, তিনি বাঙালি জাতি-সত্তার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও ছিলেন নিঃসন্দিহান। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এই জনগোষ্ঠীর সব আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন-সংগ্রামের চেতনালোকে উদ্ভাসিত এক অনড় অভিন্ন সত্তা ছিলেন কবি মাশুক চৌধুরী। সেই সময়ে ছাত্র-তরুণের যে অগ্রসর অংশ বাংলা-বাঙালির স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নস্বমগ্ন ছিল মাশুক চৌধুরী সেই স্বাপ্নিকদেরই একজন ছিলেন। যে কারণে সেই সময়ে ষাটের দশকের শেষ দিকে তাঁর লেখায় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের চিত্র ফুটে ওঠে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তাই যখন মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নাকাক্সক্ষা ও চেতনা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছিল তার প্রতিবাদে ও সুরক্ষায় যে প্রগতিশীল শক্তি সোচ্চার হয়েছিল কবি মাশুক চৌধুরী তাদের পক্ষেই কলম ধরেছিলেন, সাংবাদিকতায় এবং সৃষ্টিশীল লেখনীতে।

সেই সময়ের অত্যন্ত সাহসী সংবাদপত্র দৈনিক গণকণ্ঠ থেকে শুরু করে পরবর্তীতে বাংলার মুখ, সংবাদ, খবর, দৈনিক দেশ, জনকণ্ঠ সর্বশেষ আজকের সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

একজন কবি, সাংবাদিক, লেখক ও মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন মাশুক চৌধুরী? এ প্রশ্নের জবাবে তাঁকে যারা চেনেন জানেন প্রত্যেকেই একবাক্যে বলবেন, এমন মানুষ হয় না। এই নষ্ট-ভ্রষ্ট পচা-গলা দুর্গন্ধময় ঘাতক সময়ে মাশুক চৌধুরী ছিলেন একজন নিষ্কলুষ, নির্লোভ, নির্মোহ, সৎ ও সত্যিকার ভালো মানুষ। জুঁই ফুলের মতন সাদা মনের মানুষ। জীবনে কোনো ধান্ধাবাজি করেননি। খ্যাতি, পদ-পদবি, পুরস্কার, অর্থ-বিত্ত, সম্পদ, ভোগ-বিলাসিতা কোনো কিছুর জন্যই লালায়িত ছিলেন না। অত্যন্ত সাদামাটা, সহজ-সরল জীবন যাপন করে গেছেন। ছিলেন পরোপকারী ও বন্ধুবৎসল।

ভালোবেসেছিলেন, দেশ, মাটি, মানুষ ও মানবতাকে। সারা জীবন তাই কলম চালিয়েছেন, শব্দ সাজিয়েছেন মানব কল্যাণে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, জনগণের স্বপক্ষে। গণতন্ত্র, বাক, ব্যক্তি, চিন্তা এবং লেখার স্বাধীনতার পক্ষে। অন্যায়, অসত্য, অসুন্দর, অশুভ, অসুর, অকল্যাণের বিরুদ্ধে ছিলেন অসম সাহসী, আপসহীন কলমযোদ্ধা। মানুষের সমতায় বিশ্বাসী এই কবি ও সাংবাদিক তাই কী নির্দ্বিধায় বলেন,

একজন কবির পক্ষেই সম্ভব, এরকম

হাসতে হাসতে মৃত্যুর ভিতরে ঢুকে

সমস্ত জীবন বেঁচে থাকা-

রক্তের প্রেম দিয়ে দেশপ্রেম কাকে বলে

তার লাল ইশতেহার লেখা।”

ব্যক্তিগতভাবে আমি ছিলাম তাঁর একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত। তাঁর কবিতা দ্বারা অনুপ্রাণিত। তাঁর কবিতা পড়ে, প্রাণিত হয়ে লেখা আমার দু-একটা কবিতা অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বাংলাদেশের বড় কবি বলে পরিচিত অনেক খ্যাতিমান কবির চেয়েও বড় কবি ছিলেন মাশুক চৌধুরী। কিন্তু প্রচারবিমুখ, নির্মোহ মানুষ হওয়ায় একজন বড় কবি হওয়া সত্ত্বেও তিনি জনান্তিকেই রয়ে গেলেন। হায় দুর্ভাগা দেশ! কত নবু ছবুরা বাগিয়ে নেয় জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার আর মাশুক চৌধুরীর মতো প্রকৃত মেধাবী, প্রতিভাবান স্রষ্টারা  থেকে যান দলকানা, মোসাহেব লালনকারী রাষ্ট্রচক্ষুর আড়ালে!

তবু কবি মাশুক চৌধুরী আপনি রয়ে যাবেন আমাদের মতো আপনার অগণিত ভক্তের হৃদয়ের উষ্ণ ভালোবাসার সবুজ আলিঙ্গনে।

২৫.০৬.২০২০

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর