শিরোনাম
শনিবার, ২৭ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

রুট চিহ্নিত, তবু ঢুকছে মাদক

অপ্রতিরোধ্য মাদক ব্যবসায়ীরা

সাখাওয়াত কাওসার

করোনা মহামারীতেও বন্ধ হয়নি মাদক চোরাচালান। ৬ মার্চ থেকে গতকাল পর্যন্ত র‌্যাবের অভিযানে ৯০ কোটি টাকার মাদক জব্দ করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ছোট বড় ২ হাজার ১৫৩ মাদক ব্যবসায়ীকে। এ তথ্য দিলেন র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম।

মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস ছিল গতকাল। এদিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যে ফুটে উঠেছে দেশে মাদকের চিত্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের পর মাদকের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো জিহাদ ঘোষণা করলেও এর ধারাবাহিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞ মহল। তারা বলছেন, প্রথমে কিছুদিন জোরদার ভূমিকা রাখলেও কয়েকদিন পরই তা স্তিমিত হয়ে আসে। নির্দেশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক নেতাসহ সব মহলের আন্তরিকতার অভাবের কারণেই থামানো যাচ্ছে না মাদকের থাবা। এসব বিষয় নিশ্চিত করতে না পারলে ‘শুদ্ধ জ্ঞানেই সঠিক যত্ন হবে, জ্ঞানের আলোয় মাদক দূরে রবে’ (এ বছরের প্রতিপাদ্য) কথাটা শুধু স্লোগানেই থেকে যাবে।

জানা গেছে, মাদকের রুট চিহ্নিত হলেও বন্ধ হয়নি মাদক পাচার। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি নৌপথ, সিলেট, চট্টগ্রামের গভীর সমুদ্রবন্দর, বেশকিছু নতুন কিছু রুটও চিহ্নিত হয়েছে। একের পর এক অভিযান, বন্দুকযুদ্ধ আর সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়েও কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না মাদকের চোরাচালান, পাচার, সেবন। দেশব্যাপী ২০১৮ সালের ৪ মে বিশেষ মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত দুই বছরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৫ শতাধিক মাদক কারবারি নিহত হয়েছেন। তবু দেশে মাদকের কারবার থামানো যায়নি। এখনো সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমার ও ভারত থেকে আসছে মাদকের বড় বড় চালান। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) নূর মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মাদকবিরোধী অভিযানে গুরুত্বের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাসহ সব মহলের আন্তরিকতা না থাকলে কখনোই মাদক নির্মূল করা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীর বেশির ভাগ এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। গ্রেফতার ও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের অধিকাংশই মাদকের বাহক বা ছোট ব্যবসায়ী। ২০১৮ সালের ৪ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইয়াবার বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। টানা অভিযানে দুই দফায় কক্সবাজারের ১২৩ ইয়াবা কারবারি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তার মধ্যে ২৩ গডফাদারও রয়েছেন। যার মধ্যে কক্সবাজারের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির চার ভাই ও দুই আত্মীয়ও ছিলেন। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত আরও ৫০ গডফাদারের মধ্যে নয়জন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। বাকি ৪১ গডফাদার এখনো আত্মসমর্পণ করেননি, তারা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার বড় বড় চালান কক্সবাজার ও বান্দরবানের সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিনিয়ত আসছে বাংলাদেশে। সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের পরও তাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যাচ্ছে না। একটি রুট বন্ধ হলে পাচারকারীরা নতুন নতুন রুট আবিষ্কার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক অপরাধ বিশেষজ্ঞ শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চাহিদা থাকলে মাদকের সরবরাহ হবেই। আর মাদকের অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনেক অসৎ সদস্যও জড়িত। এদিকে, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা করোনা মোকাবিলায় ব্যস্ত থাকায় মাদকের সিন্ডিকেট আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছ। রোগী সাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে সারা দেশে মাদক ছড়িয়ে দিচ্ছেন মাদক ব্যবসায়ীরা। এরই মধ্যে র‌্যাব-পুলিশের অভিযানে তা ধরা পড়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চলমান করোনা পরিস্থিতিতেও মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে আমাদের অনেক সফলতা রয়েছে। অভিযান আরও গতিশীল করতে বাড়ানো হচ্ছে ইকুইপমেন্ট। সম্প্রতি ৩৪ জেলার মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অফিসে অপারেশনাল কাজের জন্য গাড়ি দেওয়া হয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে এ বছরের আন্তর্জাতিক মাদক পাচারবিরোধী দিবসও অন্য বছরের মতো করে পালন করতে পারছি না।’ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, সর্বশেষ ১১ বছরের মধ্যে গত বছর সারা দেশে রেকর্ডসংখ্যক আসামি গ্রেফতার হয়েছেন। পাশাপাশি নতুন রেকর্ড হয়েছে ইয়াবা উদ্ধার ও মামলারও। ২০১৯ সালে মাদক নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ১ লাখ ২৪ হাজার ৯৮টি মামলা করেছে। গড়ে প্রতিদিন মামলা হয়েছে ৩৪০টি। আর চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) মামলা হয়েছে ২১ হাজার ১১৬টি। এ হিসাবে গড়ে প্রতিদিন মামলা হয়েছে ৩৫১টি। ২০১৯ সালে মাদকসংশ্লিষ্ট আসামি গ্রেফতার হয়েছেন ১ লাখ ৬২ হাজার ৮৪৭ জন। ২০২০ সালের প্রথম দুই মাসে মাদক মামলায় আসামি গ্রেফতার হয়েছেন ২৭ হাজার ৩৭২ জন। ২০১৯ সালে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ৩ কোটি ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩২৮ পিস। জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৪ মে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরুর পর থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে গত ২৫ মাসে সারা দেশে ৫১৯ মাদক কারবারি ‘বন্দুকযদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। এর বাইরে নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হয়েছেন আরও ৮৬ জন। এদিকে নৌপথে নতুন রুটের বিষয়ে কথা হয় নৌপুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোল্যা নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নৌপুলিশ একটি নতুন ইউনিট। সম্প্রতি আমরা মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছি। আমরা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করছি। শিগগিরই মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর