রবিবার, ২৮ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা
চমকপ্রদ তথ্য হলফনামায়

এমপি হয়েই সম্পদের পাহাড়

হয়েছেন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক, স্ত্রীর নামে বিপুল সম্পদ, কৃষিজমি বেড়ে ১২ বিঘা

গোলাম রাব্বানী

এমপি হয়েই সম্পদের পাহাড়

এমপি হয়ে টাকার কুমির বনে গেছেন নাঈমুর রহমান দুর্জয়। রাতারাতি আঙ্গল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন বিতর্কিত এই এমপি। পাঁচ বছরে তার আয় বেড়েছে আট গুণ। বার্ষিক আয় মাত্র ৫ লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে অর্ধকোটি টাকা। শূন্য হাতে এমপি হয়ে এখন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক তিনি। ঘুরে বেড়ান বিলাসবহুল গাড়িতে। গড়ে তুলেছেন নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড়। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে তার জমা দেওয়া হলফনামা বিশ্লেষণে এমন চমকপ্রদ তথ্য মিলেছে। হলফনামা অনুসারে, মানিকগঞ্জ-১ আসনের এমপি দুর্জয় এইচএসসি পাস। বিগত দুই নির্বাচনে পেশা দেখিয়েছেন ব্যবসা। তবে দশম সংসদ নির্বাচনের সময় তার কোনো ব্যবসায়িক মূলধন ছিল না। নামকাওয়াস্তে ছিলেন চেজ ট্রেডিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ফুওয়াং ফুড অ্যান্ড বেভারেজের পরিচালক। নির্বাচনের পর এখন তিনি চেজ পাওয়ার লিমিটেডের পরিচালক। প্রশ্ন উঠেছে, এমপি হওয়ার পর অদৃশ্য জাদুর ছোঁয়ায় নাঈমুর রহমান দুর্জয় পাওয়ার প্লান্টের মালিক কীভাবে হলেন? কীভাবে তিনি রাতারাতি গড়ে তুললেন অঢেল সম্পদ আর প্রাচুর্য। কীভাবে গড়ে তুললেন মালয়েশিয়ায় নানা রকম ব্যবসা-বাণিজ্য। এসব নিয়ে তার নির্বাচনী এলাকায় আলোচনা-সমালোচনা মানুষের মুখে মুখে। এ ছাড়া স্ত্রী, চাচা এবং পারিবারিকভাবে সম্পর্কিত অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদ গড়েছেন তিনি। এমনকি হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দশম সংসদ নির্বাচনের সময় নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বার্ষিক আয় ছিল মাত্র ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এর মধ্যে কৃষি থেকে আয় হতো ১ লাখ টাকা। আর ব্যবসা থেকে আয় হতো ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা। কিন্তু দশম সংসদের এমপি হওয়ার পরে পাঁচ বছরে তার আয় ৫ লাখ ৭০ হাজার থেকে হয়েছে ৪৩ লাখ ৭৫ হাজার ২০০ টাকা। এক্ষেত্রে কৃষি খাত থেকে বছরে ৫২ হাজার ৮০০ টাকা, পারিতোষিক ও ভাতাদি থেকে আয় ২৩ লাখ ৪২ হাজার ৪০০ টাকা এবং মৎস্য চাষ থেকে আয় দেখিয়েছেন ১৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা। দশম সংসদ নির্বাচনের সময় তার হাতে নগদ মাত্র ১ লাখ টাকা থাকলেও পাঁচ বছর পরে একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় তার হাতে নগদ টাকা ছিল ৩৫ লাখ। দশম সংসদ নির্বাচনের সময় তার কোনো ব্যবসায়িক মূলধন না থাকলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যবসায়িক মূলধন দেখিয়েছেন ৩৪ লাখ ৩৯ হাজার ৪৪৭ টাকা। এ ছাড়া বেড়েছে ব্যবসার পরিধিও। হয়েছেন পাওয়ার প্লান্টের মালিক।

দশম সংসদ নির্বাচনের সময় তার দুটি সাধারণ গাড়ি থাকলেও এখন রয়েছে ৫০ লাখ টাকার ল্যান্ড ক্রুজ, ৩৬ লাখ টাকার সেলুকার ও সাড়ে ১৬ লাখ টাকার মার্ক-২ টয়োটা গাড়ি। দশম সংসদ নির্বাচনের সময় তার ব্যাংকে জমা ছিল ৫ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে ছিল ১ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে আরও ছিল ৫০ ভরি স্বর্ণ। আর অন্যান্য খাতে তিনি ১ লাখ টাকা দেখিয়েছিলেন। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় তিনি স্ত্রীর নামে কোনো সম্পদ দেখাননি। এ নির্বাচনে তিনি হলফনামায় স্ত্রীর তথ্য গোপন করেছেন।  অন্যদিকে এমপি হওয়ার পরে হু হু করে বেড়েছে তার স্থাবর সম্পদ। দশম সংসদ নির্বাচনের সময় তার কৃষি জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫০ ডিং। মূল্য ছিল ৫০ লাখ টাকা। অকৃষি জমি ছিল ২ ডিং ১০ লাখ টাকার। নিজের নামে ১০ লাখ টাকার ১টি দালান ছিল। আর স্ত্রীর নামে ছিল ঢাকায় ৩ কাঠার প্লট। কিন্তু একাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তিনি স্ত্রীর কোনো সম্পদ দেখাননি। আর তার নামেও বেড়েছে সম্পদের পরিমাণ। পাঁচ বছর পরে একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় তার কৃষিজমির পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১২ বিঘা। অকৃষি জমি দেখিয়েছেন ১৫ শতাংশ। আর একতলা একটি বাড়ি। এ ছাড়া হলফনামায় আইএফআইসি ব্যাংকে তিনি ১২ লাখ ৮২ হাজার ৭১১ টাকার ব্যক্তিগত ঋণ দেখিয়েছেন। 

 

স্ত্রীর নামে সম্পদের পাহাড়, হিসাব নেই হলফনামায় : নাঈমুর রহমান দুর্জয় তার স্ত্রী ফারহানা রহমান হ্যাপির নামেও সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। তবে সেই সম্পদের হিসাব তিনি একাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় দেখাননি। দুর্জয়ের জমি দখলের কাজ করেন তার চাচা। দুর্জয় বাহিনীর জমি দখলের বিষয়টি এখন মানিকগঞ্জজুড়ে ‘ওপেন সিক্রেট’। জেলায় কেউ জমি কেনাবেচা করতে চাইলে আগেই ‘ভাগ’ রেখে দিতে হয়। আর যারা ভাগ দেন না, তারা জমি কেনাবেচা করতে পারেন না। আর বেশি ঝামেলা করতে চাইলে সেই জমি চলে যায় দুর্জয়ের দখলে।

জানা গেছে, দুর্জয় এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর বিগত পাঁচ-ছয় বছরে শুধু দৌলতপুর এলাকাতেই শতাধিক একর খাস জমি দখল করে নিয়েছেন। উপজেলা সদরের খাল-নালা ভরাট করে তা পজেশন আকারে বিক্রি করার ঘটনাও ঘটেছে। দৌলতপুর বাজারে জেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই সরকারি নালা দখল করে ভরাট হয়েছে, সেখানেই এখন গড়ে উঠেছে বড় আকারের মার্কেট। দোকানপ্রতি পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে ‘পজেশন’ বরাদ্দও দিয়েছেন টিপু। অভিযোগ আছে, জমি দখলের মহড়ায় যুক্ত আছেন এমপিপত্নী ফারহানা রহমান হ্যাপি। তরা-মূলজান শিল্পাঞ্চলের অনেক জায়গাজমি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে হ্যাপির নামেও। তার নামে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক সংলগ্ন সড়ক ও জনপথের বহু দামি জায়গা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। মূলজান এলাকায় এই জমিতেই হ্যাপির নামে দুর্জয় পরিবারের শপিং মল তৈরি করার পরিকল্পনা চলছে। এ ছাড়া তরা ক্রসব্রিজ থেকে মানিকগঞ্জ সদর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার মহাসড়কের চারটি পয়েন্টে অন্তত পাঁচ একর জায়গা দখল করা হয়েছে। সেসব স্থান কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আলাদা সীমানা করে দেওয়া আছে। এ ছাড়া কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করারও অভিযোগ আছে হ্যাপির বিরুদ্ধে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মেগা ফিড কারখানার পেছনে অন্তত তিনটি স্পটে ফসলি জমি দখল করে মাটি বিক্রি করা হচ্ছে। সেই মাটি আনা-নেওয়ার কাজে ট্রাক চালিয়ে ক্ষতি করা হচ্ছে আশেপাশের ফসলি জমির।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর