সোমবার, ২৯ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

বন্ধ হচ্ছে সরকারি ২২ পাটকল

গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে বাড়ি যাচ্ছেন ২৪ হাজার ৮৮৬ কর্মী

আকতারুজ্জামান

বন্ধ হচ্ছে সরকারি ২২ পাটকল

বিশ্ববাজারের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না সরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) ২৫টি পাটকল। অর্ধশত বছরের পুরনো যন্ত্রপাতির উৎপাদন সীমাবদ্ধতায় ক্রমাগত লোকসানে জর্জরিত এসব পাটকল অবশেষে বন্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক প্রক্রিয়ায় বাড়ি পাঠানোর ঘোষণা আসছে। দুই মাসের সময় দিয়ে শিগগিরই পাটকলগুলোতে এ সংক্রান্ত আদেশ পাঠানো হবে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এ দুই মাসের মধ্যে শ্রমিকদের পাওনাদিও পরিশোধ করবে সরকার। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে এসব কর্মীকে ছাঁটাইয়ের ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন শ্রমিক ও রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা। এদিকে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক প্রক্রিয়ায় অবসায়নের পর পাটকলগুলোকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী আধুনিকায়ন করা হবে বলে গতকাল জানিয়েছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। গতকাল বিজেএমসি এর কার্যক্রম পর্যালোচনা বিষয়ে অনলাইন ব্রিফিংয়ে মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, ক্রমবর্ধমান লোকসানের কারণে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক প্রক্রিয়ায় অবসায়নের মাধ্যমে মিলগুলোকে বর্তমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী আধুনিকায়ন করা হবে। সভায় বস্ত্র ও পাট সচিব লোকমান হোসেন মিয়া ও অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রী আরও বলেন, ২০১৪ সাল হতে অবসরপ্রাপ্ত ৮ হাজার ৯৫৪ জন শ্রমিকের প্রাপ্য সব বকেয়া, এ ছাড়া বর্তমানে কর্মরত ২৪ হাজার ৮৮৬ জন শ্রমিকের প্রাপ্য বকেয়া মজুরি, শ্রমিকদের পিএফ জমা, গ্র্যাচুইটি এবং সে সঙ্গে গ্র্যাচুইটির সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ হারে অবসায়ন সুবিধা একসঙ্গে শতভাগ পরিশোধ করা হবে। এ জন্য সরকারি বাজেট হতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা প্রদান করা হবে। জানা গেছে, অবসায়নের পর মিলগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণে পিপিপি/যৌথ উদ্যোগ/জিটুজি/লিজ মডেলে পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হবে। নতুন মডেলে পুনঃচালুকৃত মিলে অবসায়নকৃত বর্তমান শ্রমিকেরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজের সুযোগ পাবে। একই সঙ্গে এসব মিলে নতুন কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের সরকারি ভর্তুকির মাধ্যমে এতদিন বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হচ্ছিল জানা গেছে। তথ্যমতে, বেসরকারি খাতে শ্রমিকদের মাসিক মূল মজুরি ২৭০০ টাকার বিপরীতে উৎপাদনশীলতা ও মজুরি কমিশন ২০১৫ বাস্তবায়নের পর সরকারি বিজেএমসির পাটকলসমূহে তা ৮৩০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। ফলে সরকারি মিলে ইউনিট প্রতি উৎপাদন খরচে মজুরির অংশ ৬০ শতাংশ থেকে ৬৩ শতাংশ বেড়েছে। এটি বেসরকারি খাতের প্রায় তিনগুণ।

মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, উৎপাদন খরচ অস্বাভাবিক বেশি হওয়ায় বাজারে টিকে থাকার জন্য বিজেএমসিকে হ্রাসকৃত দরে পণ্য বিক্রয় করতে হয়। এতে করে পাটখাতে সার্বিক প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের মিলগুলো উৎপাদিত পণ্যের দর নির্ধারণের ক্ষেত্রে অসুবিধার সম্মুখীন হয়। উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে পণ্য বিক্রয়ের প্রতিক্রিয়ায় ভারত ইতিমধ্যে বাংলাদেশ হতে পাটপণ্য আমদানিতে এন্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে। এতে কেবল বিজেএমসিই নয়, বেসরকারি খাতের রপ্তানিকারকেরাও বিপাকে পড়েছে।

জানা গেছে, বর্তমানে পাটপণ্য উৎপাদনে বিজেএমসির অবদান মাত্র ৮ দশমিক ২১ শতাংশ, রপ্তানিতে এ হার আরও কম ৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

এ ছাড়া পলিথিন ও প্লাস্টিক দ্রব্যের অতি ব্যবহারের দরুন বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে পাটসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক তন্তুর কদর সম্প্রতি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ পরিষদে দ্বিতীয় কমিটিতে ‘প্রাকৃতিক তন্তুর উদ্ভিজ্জ ও টেকসই উন্নয়ন’ শিরোনামে পাটসহ প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যবহার বিষয়ক একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এর ফলে আন্তর্জাতিকভাবে পাটের কদর ও ব্যবহারিক মূল্য বৃদ্ধির একটি সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। গত দুই দশকে বিশ্বজুড়ে পাটের তৈরি নানাবিধ ও বহুমুখী পণ্যের চাহিদা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। কিন্তু বহুমুখী পাটপণ্যের উপযোগী কাঁচামাল তৈরির উৎপাদনের ক্ষমতা বিজেএমসির পাটকলসমূহের নেই। এ ছাড়া প্রায় ৬০/৭০ বছর পূর্বের যন্ত্রপাতি দিয়ে স্থাপিত এসব মিলের কার্যক্ষমতা সময়ের ব্যবধানে হ্রাস পেয়ে প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমেছে। তাছাড়া, বিজেএমসির পুরনো ব্যবস্থাপনা কাঠামো আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার উপযোগী নয়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া : শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক প্রক্রিয়ায় ছাঁটাই করে পাটকল বন্ধ করার ঘোষণায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন শ্রমিক, রাজনীতিকসহ বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা। বিজিএমসি কর্তৃক পরিচালিত পাটকলসমূহ আধুনিকায়ন করে কার্যকর, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার দাবিতে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বরাবর সুপারিশ পত্র দাখিল করেছেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি শহীদুল্লাহ চৌধুরীসহ অন্যরা। সুপারিশপত্রে বলা হয়, স্বাধীনতার স্বপক্ষের দাবিদার শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতাই থেকে এমন শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্ত নেওয়া দুঃখজনক। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাম ঐক্য ফ্রন্ট। গতকাল অনলাইনে এক বৈঠকে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বলেন, পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে, শুধু পাটকল শ্রমিকরা বেকার হবে ও তাদের পরিবারগুলো বিপন্ন হবে- তাই নয়। ধ্বংস হয়ে যাবে একটি সম্ভাবনাময় শিল্প আর পাটচাষিরাও ঘোর অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে। তাদের পরিবারগুলোতে বিপর্যয় নেমে আসবে। পাটকল বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল করতে দেশের সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংগঠন ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

পাটকল বন্ধ হলে তীব্র গণআন্দোলন : নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) অধীন পাটকলগুলো বন্ধের পরিকল্পনা করছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। কারণ হিসেবে ক্রমাগত  লোকসানের কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে পরবর্তী সময়ে সরকারি- বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) ভিত্তিতে পুনরায় পাটকলগুলো চালু করা হবে বলে জানানো হয়েছে। তার মানে বেসরকারি অংশীদারিত্বে পরিচালিত হলে লোকসান হবে না। সরকারের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, লুটপাট আজ পাটশিল্পকে এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে। অথচ কয়েক দশক ধরে এই শিল্পই বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ ছিল। পাটকল শিল্প বন্ধ হলে সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এ কথা বলেন। মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এত বড় একটা বিপর্যয়ের মধ্যে নতুন করে দেশের ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের ২৫ হাজার শ্রমিককে কর্মহীন করার সিদ্ধান্ত  কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এই শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়মিতই বকেয়া হয়ে পড়ে। পাওনা আদায়ের জন্য শ্রমিকদের প্রায়ই আন্দোলনে নামতে হয়। বিগত বছরগুলোয় যারা অবসরে গেছেন, তারা অবসর সুবিধাও পাচ্ছেন না।

মান্না বলেন, করোনা মহামারীতে যেখানে সরকারের পাটকল শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর কথা, সেখানে এরকম একটি সিদ্ধান্ত সরকারের জনবিচ্ছিন্নতাকে আরেকবার সামনে এনেছে। আমি নাগরিক ঐক্যের পক্ষ থেকে সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করছি এবং পাটকল শ্রমিকদের বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি।

সর্বশেষ খবর