শনিবার, ৪ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাকালেও ভুয়াদের দৌরাত্ম্য

ভুয়া টেস্ট নকল সনদ, প্লাজমা ব্যবসায় প্রতারক চক্র

নিজস্ব প্রতিবেদক

মহামারী করোনাভাইরাসে প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে মৃত ও আক্রান্ত মানুষের তালিকা। উপসর্গ থাকায় টেস্ট করাতে আগ্রহী মানুষের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। মানুষের প্রয়োজনীয়তাকে কাজে লাগিয়ে প্রতারক চক্র টেস্টের নামে অর্থ হাতিয়ে ভুয়া রিপোর্ট দিচ্ছে। আক্রান্ত রোগীদের প্লাজমা দেওয়ার নামে চলছে ব্যবসা।

‘বুকিং বিডি’ ও ‘হেলথ কেয়ার’ এই দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল করোনা পরীক্ষার। বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই করোনাভাইরাস পরীক্ষা করানোর জন্য যোগাযোগ করেন। এই প্রতারক চক্রের সদস্যরা নমুনা সংগ্রহের পর কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই কম্পিউটারে মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করত। যাদের উপসর্গ রয়েছে তাদের পজিটিভ ও যাদের উপসর্গ নেই তাদের নেগেটিভ রিপোর্ট মেইল করে জানিয়ে দিত। এ জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির কাছ থেকে তারা ৫-১০ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিত। গত ২৩ জুন এই প্রতারক চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি তেজগাঁও থানা পুলিশ জানতে পারে, বুকিং বিডি ও হেলথ কেয়ার নামে দুটি প্রতিষ্ঠান ভুয়া করোনা পরীক্ষার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। বিষয়টি অনুসন্ধানের পর অভিযান শুরু করে পুলিশ। একপর্যায়ে তারা এই প্রতারক চক্রের মূলহোতা হুমায়ুন কবীর ও তানজিনা পাটোয়ারীকে গ্রেফতার করে। পরে তাদের দেওয়া তথ্যমতে, গুলশানের কনফিডেন্স টাওয়ারে অভিযান চালিয়ে বাকি তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও জোনের সহকারী কমিশনার মাহমুদ খান বলেন, ‘প্রতারকদের কাছ থেকে জব্দ করা দুটি ল্যাপটপে প্রাথমিকভাবে ৩৭টি করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট পাওয়া গেছে। আরও কয়েকটি ল্যাপটপ ও কম্পিউটারে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট রয়েছে। এই প্রতারক চক্র সাধারণ মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে প্রতারণা করে আসছিল।’ তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতার হওয়া আরিফুল চৌধুরী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জেকেজির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। আর হুমায়ুন কবীর ও তানজিনা দম্পতি জেকেজির সাবেক স্টাফ। এর ঘটনার পরেই কভিড-১৯ সন্দেহভাজন রোগীর নমুনা সংগ্রহ, কেন্দ্র স্থাপন ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জেকেজি হেলথ কেয়ারের অনুমোদন বাতিল করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। গত ২৪ জুন অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ নির্দেশ দেওয়া হয়। গত এপ্রিলে কভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষার জন্য অনুমতি পায় জোবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা (জেকেজি) হেলথ কেয়ার। জেকেজি বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহের জন্য ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পৃথক ছয়টি স্থানে ৪৪টি বুথ স্থাপন করেছিল। এসব এলাকা থেকে প্রতিদিন ৩০০-৩৫০ জনের নমুনা সংগ্রহ করত জেকেজি। শর্ত ছিল, সরকার নির্ধারিত করোনা শনাক্তকরণ ল্যাবরেটরিতে নমুনা পাঠাতে হবে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে।

নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘জেকেজির বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জে তিনটি গুরুতর অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে করোনার রেজাল্ট প্রদান, নমুনা সংগ্রহ করে তার কোনো রেজাল্ট না দেওয়া এবং দুটি কেন্দ্রে সকাল ৯টা থেকে নমুনা সংগ্রহের কথা বলে বেলা ১২টায় তারা কার্যক্রম শুরু করত। এমন বেশকিছু অভিযোগ আমরা পেয়ে আসছিলাম। তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’ প্লাজমা থেরাপি নিয়েও চলছে প্রতারণা। প্লাজমা দাতা খুঁজতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন গ্রুপ। এখানেই জাল বিছিয়েছে প্রতারক চক্র। এসব গ্রুপে ওতপেতে থাকে সুযোগসন্ধানীরা। তারা পোস্টদাতার দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করে বলেন, রক্তের গ্রুপ অনুযায়ী দাতা আছে। ঢাকার ভিতরে রোগী হলে বলা হয় প্লাজমা দাতা ঢাকার বাইরে আছেন। তাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হলে আসতে পারার কথা জানানো হয়। এক্ষেত্রে যাতায়াত খরচ বাবদ ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা দাবি করেন। সরল বিশ্বাসে মানুষ টাকা পাঠিয়ে দিলে টাকা পাওয়ার পর মোবাইল হয়ে যায় বন্ধ। ওই কথিত দাতাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে প্লাজমার কথিত দাতার এবং প্লাজমার প্রয়োজন এমন একজন ব্যক্তির কথোপকথন পাওয়া যায়। জানা যায়, প্লাজমার প্রয়োজন জানিয়ে কথা বলেন ঢাবির এক শিক্ষার্থী। ডোনার খুঁজে দেওয়ার কথা বলে প্রতারক চক্রের একজন ওই শিক্ষার্থীর পোস্টে কমেন্ট করে নম্বর দেন। সেখান থেকে নম্বর নিয়ে ওই শিক্ষার্থী তাকে ফোন দেন। ফোন দিলে প্লাজমা দাতা জোগাড় করে দিতে ওই ব্যক্তি এক লাখ টাকা দাবি করেন। এই টাকার বিনিময়ে প্লাজমা দাতা পাওয়া যাবে বলে জানান। ফেসবুকে প্লাজমার সন্ধান পেতে বিভিন্ন গ্রুপে অনেকেই পোস্ট দেন।। গত ১৭ জুন একটি নম্বর থেকে কয়েকজনকে ফোন দেওয়া হয় প্লাজমা দাতার কথা জানিয়ে। কিন্তু ওই নম্বরের ব্যক্তি জানান, রক্ত দিতে হলে টাকা দিতে হবে আগে এবং টাকা পেলে প্লাজমা দাতা আসবে। প্লাজমা প্রাপ্তির ব্যাকুলতায় কয়েকজন প্রথমবার দুই হাজার টাকা এবং পরেরবার এক হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন ওই নম্বরে। টাকা পাওয়ার পর ওই নম্বর বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভুক্তভোগীরা জানান, ওই ব্যক্তি এরকম আরও কয়েকজনের সঙ্গে একই কাজ করেছে বলে তারা জানতে পারেন। ওই ব্যক্তির নম্বর প্লাজমা সন্ধানের বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট করে সবাইকে সতর্ক করেছেন তারা। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে জানার পর ওই নম্বরে ফোন দিয়ে বন্ধ পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, মহামারীতে মানুষ হিসেবে কর্তব্য মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এটা ব্যবসা করা কিংবা প্রতারণার সময় না। এই দুর্যোগেও যদি মানুষের বিবেকবোধ জাগ্রত না হয় তাহলে সত্যিই দুঃখের বিষয়। প্রতারকদের রুখতে সজাগ থাকতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও সতর্ক থাকতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর