রবিবার, ৫ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক যতীন

দুনিয়ায় এখন যে বিপর্যয় চলছে মানুষই তা দূর করে দেবে

আলপনা বেগম, নেত্রকোনা

দুনিয়ায় এখন যে বিপর্যয় চলছে মানুষই তা দূর করে দেবে

বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, গ্রন্থকার ও সমাজচিন্তক অধ্যাপক যতীন সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, করোনার ছোবলে দুনিয়াজুড়ে যে বিপর্যয় চলছে মানুষই একদিন তা দূর করে দেবে। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও মনে করেন, ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।’ জ্ঞানতাপস এই সমাজহিতৈষী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আরও বলেন, পড়াশোনা সঠিকভাবে করলে অর্জিত জ্ঞান দিয়ে যে কোনো বিপর্যয় রুখে দেওয়া যায়। পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই।

যতীন সরকারের জন্ম নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দপাড়া গ্রামে ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট। বর্তমানে তিনি বাস করেন জেলা শহরের সাতপাই এলাকায়। তার বাড়ির নাম ‘বানপ্রস্থ’। তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন ২০০৮ সালে। ২০১০ সালে তাকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৫। সম্প্রতি টেলিফোনে তার সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়। সাক্ষাৎকারের সারাংশ তুলে ধরা হলো-

বাংলাদেশ প্রতিদিন : কেমন আছেন স্যার।

যতীন সরকার : দীর্ঘদিন ধরেই আমি আর্থরাইটিসে ভুগছি। তা সত্ত্বেও কিছু কিছু কাজ করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু গত এক বছর যাবৎ আমি একেবারে গৃহবন্দী হয়ে পড়েছি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : করোনা মহামারী বিষয়ে আপনার ধারণা...

যতীন সরকার : দেশে বা পৃথিবীতে যা ঘটে সেটা তো আমার মাথার মধ্যে কোনো না কোনোভাবে প্রভাব বিস্তার করে। করোনা নামক যে বিপর্যয়, তাকে বিশ্ব বিপর্যয় বলতে পারি। এমন ঘটনা পৃথিবীতে এর আগে কোথাও ঘটেছে কি না আমার অন্তত জানা নেই। আগে হয়তো একটা দেশে বা একটা অঞ্চলে কিছু বিপর্যয় ঘটেছে, তার পরে পৃথিবীর সব মানুষ মিলে তার সমাধানও করেছে। কিন্তু এই সময়ে সমগ্র পৃথিবীতে যে বিপর্যয় তা থেকে কে রক্ষা করবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সংকটটাকে কীভাবে দেখছেন স্যার।

যতীন সরকার : স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমরা দিগি¦দিক দৌড়াদৌড়ি করেছি। চেষ্টা করেছি হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে কীভাবে নিজেদের রক্ষা করা যায়। কীভাবে তাদের প্রতিরোধ করা যায়। এক পর্যায়ে আমরা একত্র হয়েছি। চিন্তা করে কথা বলে স্বাধীনতা এনেছি। আর এখন মানুষকে মানুষ থেকে এমনভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে এবং বিচ্ছিন্নতাই এখন সমাধান বলা হচ্ছে। বলছে ঘরের মধ্যে বসে থাকবে। আর এই ঘরের মধ্যে বসে থাকা, মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ না থাকা, এটা যে কত বড় একটা বিপর্যয় তা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, মানুষ তো শুধু ঘরে বসে থাকতে পারে না। যারা দিন আনে দিন খায়, এমন মানুষগুলোর অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে সে কথাও তো অতি সহজে বোঝা যায়। এই অবস্থায় কোনটা যে করা হবে এটাই মানুষ এখনো বুঝে উঠতে পারছে না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : তবে কি করোনাভাইরাসের সামনে মানুষ খুবই অসহায়!

যতীন সরকার : আমি তো ঘরের মধ্যেই বন্দী এবং আমার ঘরের ভিতরে কেউ আসে না, বাড়ির মেইন গেটে তালা লাগানো আছে। কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই এবং এই যে একটা অবস্থা, তা আমাকে মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত করে ফেলছে। তবুও এ অবস্থা থেকে যে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে আমি কিন্তু নিঃসন্দেহ। আমি বিশ্বাস করি যে, মানুষই পারবে এটা দূর করতে। যত রকমের বিপর্যয় পৃথিবীতে আগে ঘটেছে সব রকমের সমাধান মানুষই করেছে। এখন যে অবস্থা দেখা দিয়েছে মানুষই তা দূর করবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : করোনার অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কিছু কিছু দেশ বিচ্ছিন্নভাবে সচেষ্ট।

যতীন সরকার : আগে যে কোনো একটা দেশে কোনো একটা বিপর্যয় ঘটত। কিন্তু এই করোনা সারা পৃথিবীর মানুষের মাঝে একসঙ্গে দেখা দিয়েছে। কাজেই পৃথিবীর সব মানুষকেই যেভাবেই হোক মিলাতে হবে এবং বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আর সম্ভাবনা একেবারে নেই এমন কথা কিন্তু বলা যায় না।

ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য চেষ্টা হচ্ছে। কত দিন লাগবে জানি না কিন্তু মানুষ এই প্রতিষেধক আবিষ্কার করবেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।’ সেই বিশ্বাস আমাদের সব সময় রক্ষা করতে হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বলা হয়, করোনা বিপর্যয়ের কারণে শক্তিমান দেশগুলোর মনমানসিকতা ঝাঁকুনি খেয়েছে। আপনি কী মনে করেন।

যতীন সরকার : এখন মানুষে মানুষে বিছিন্নতা, একসঙ্গে কেউ মিলিত হতে পারছে না। আইসোলেশন তৈরি করা হয়েছে। তার মধ্যেও আমরা দেখেছি চীনকে যেখানে করোনার মহামারী প্রথম শুরু হয়েছিল, সেই চীনই এখন বিভিন্ন দেশে এমনকি আমাদের বাংলাদেশেও প্রতিনিধি দল পাঠাচ্ছে। সমাধানের অভিজ্ঞতা যেটি সেটি সবার সঙ্গে বিনিময় করার জন্য। এভাবে পৃথিবীর সব মানুষ আবার মিলবে। মিলেই তারা কোনো না কোনোভাবে এই বিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করবে। এখন পৃথিবীর সব মানুষকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে গিয়ে মানুষের মাঝে যে নতুন সম্মিলন ঘটবে তাতে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার সৃষ্টি হবে মনে করি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সর্বসাম্প্রতিক তথ্যাবলির সঙ্গে কীভাবে সংযুক্ত থাকছেন স্যার।

যতীন সরকার : পত্রপত্রিকা এখন আর আসে না। নেত্রকোনায় নাকি একেবারে আসেই না। যে কারেণ আমার হকার পত্রিকা নিয়ে আসে না। এইটাতে আরও বিপযস্ত মানুষ। পৃথিবীর খবরটা যথাযথভাবে পেতে হলে টেলিভিশনের পাশাপাশি পত্রপত্রিকাও পড়তে হয়। টিভিতে যতটুকু পাওয়া যায় সেটা বিস্তৃত নয়। বিস্তৃতভাবে পেতে পারতাম যেটিতে সেটি পাচ্ছি না পত্রিকা না থাকার জন্য।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : চলমান চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে যদি কিছু বলেন...

যতীন সরকার : করোনার প্রকোপের ফলে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে করোনা রোগীর খুব ভিড়। এর ফলে সব রোগী যেমন ভর্তি হতে পারছে না অন্যান্য রোগীও হাসপতালে জায়গা পাচ্ছে না। করোনাই শুধু নয়, অন্যান্য রোগেও মানুষের এখন এমন এক অবস্থা হযেছে যে, এটা আগে কল্পনাও করা যায়নি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : শিক্ষা ব্যবস্থা যে ধাক্কা খেয়েছে তার সমাধান কীভাবে আসতে পারে।

যতীন সরকার : স্কুল-কলেজের যে অবস্থা হয়েছে অর্থাৎ শিক্ষা খাতে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে তার সমাধানটা সহজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। পড়াশোনার জন্য আবার যদি স্কুল- কলেজ খুলে দেওয়া হয় তাহলে ছেলেমেয়েদের বিপদে ফেলে দেওয়া হবে। সুতরাং তা করা যাবে না। আবার লেখাপড়া যে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এই অবস্থাও মেনে নেওয়া যায় না। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নানা ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে আসছে। এরই মধ্যে করোনা নতুন বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। এই বিপর্যয়ও মানুষই দূর করবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : শিক্ষার্থীদের জন্য আপনার বার্তা কী?

যতীন সরকার : শিক্ষার্থীদের বলি, বিপর্যয় পৃথিবীতে বরাবরই এসেছে। করোনাকালে বাড়িতে বসেই পড়াশোনা করে যেতে হবে। পড়াশেনার বিকল্প কোনো কিছু নেই। আমরা পড়াশোনা সঠিক নিয়মে করি না বলেই বিভিন্ন সময়ে সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে বিপর্যয়ে পড়ি। সেটা থেকে পরে হয়তো উত্তরণও করি। কিন্তু আগে থেকে প্রস্তুত থাকলে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার ভাঙন কমই হবে।

সর্বশেষ খবর