সোমবার, ৬ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

বিভাগীয় শহরে বেহাল সবকিছু

চট্টগ্রামে শয্যা সংকট কমলেও বাড়ছে ভোগান্তি, সিলেটে আইসিইউর জন্য হাহাকার রাজশাহীতে রোগীর পাশে শুধুই স্বজনরা, খুলনায় অক্সিজেন সংকটে ভোগান্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিভাগীয় শহরে বেহাল সবকিছু

রাজশাহীর খ্রিস্টান মিশন হাসপাতাল, যা এখন করোনা রোগীদের জন্য বিশেষায়িত। করোনা উপসর্গ নিয়ে এখানেই ভর্তি হয়েছেন মোর্শেদা বেগমের স্বামী। তীব্র শ্বাসকষ্ট হওয়ায় স্বামীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা তার। তাই নিচতলা থেকে অক্সিজেনের সিলিন্ডার দোতলায় টেনেহিঁচড়ে তুলছেন একাই। সংকটময় মুহূর্তেও মোর্শেদা বেগমকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসেননি হাসপাতালের কেউই। রাজশাহীতে করোনা বিশেষায়িত হাসপাতালে জীবন বাঁচাতে অক্সিজেনের সিলিন্ডার নিয়ে ছোটাছুটি করতে হয় রোগীদেরই। বিপদাপন্ন অবস্থাতেও রোগীর কাছে এগিয়ে আসেন না হাসপাতালের নার্স কিংবা স্টাফরা। আর নিজেদের নিরাপত্তার অজুহাতে চিকিৎসকরা সবসময়ই থাকেন নিরাপদ দূরত্বে। পুরনো ভবনে অন্ধকারাচ্ছন্ন ও ভুতুড়ে পরিবেশে করোনার চিকিৎসাসেবা নিতে এসে পদে পদে হয়রানি হচ্ছেন রোগীরা। রাজশাহীতে ভেঙে পড়েছে চিকিৎসাসেবা। ভুতুড়ে খ্রিস্টান মিশন হাসপাতালকে বিশেষায়িত হিসেবে চুক্তি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মাসে ১২ লাখ ভাড়াও দিচ্ছে সরকার। কিন্তু সেখানে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। হাসপাতালগুলোতে করোনা আক্রান্ত রোগী তো দূরের কথা, অন্যান্য রোগের চিকিৎসাসেবাও ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রোগী ও তাদের স্বজনদের। একই সঙ্গে তারা জানিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের ঠিকমতো চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে না। অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে রোগী; চিকিৎসক বা নার্সদের কাছে পাচ্ছে না রোগীরা। পূর্বপরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে রামেক হাসপাতালের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা যে হারে প্রতিদিন আক্রান্ত হতে শুরু করেছেন তাতে করে হাসপাতালে নতুন করে চিকিৎসক ও  স্বাস্থ্যকর্মীদের সংকট দেখা দিয়েছে। সিনিয়র চিকিৎসকরা শুরু থেকেই হাসপাতালে ঠিকমতো ডিউটি করছেন না বলেও অভিযোগ আছে।

করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে রাজশাহীর মতো চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশা দেশের অন্যান্য স্থানেও। চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও উপসর্গের রোগীদের চিকিৎসায় সেবার পরিধি বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু শয্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীদের ভোগান্তিও বেড়েছে। অভিযোগ আছে, শয্যা বাড়লেও ভর্তি থাকা রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা পেতে নানা ক্ষেত্রে দুর্ভোগ-ভোগান্তি কমেনি। রোগীর প্রতি অবহেলা, প্রয়োজনীয় সেবা দিতে অনীহা প্রকাশ, নার্স-চিকিৎসকদের রোগের কথা বললে না শোনাসহ নানা অভিযোগ নিত্যদিনের। সর্বশেষ গতকাল চমেক হাসপাতালে অবহেলায় দুজন রোগী মারা যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। গতকাল সকালে চমেক হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে বিনা চিকিৎসায় রেশমী নামের ১৯ বছর বয়সী এক তরুণীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনরা। অন্যদিকে, মানসিক স্বাস্থ্য ওয়ার্ডেও চিকিৎসকের অবহেলায় শামীমা আক্তার নামে এক রোগীর মৃত্যু হয় বলে স্বজনদের অভিযোগ। করোনা ওয়ার্ডের এক রোগীর স্বজন নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘এখন কঠিন মুহূর্তে আমরা বাধ্য হয়ে হাসপাতালে রোগী ভর্তি করেছি। কিন্তু ওয়ার্ডের নার্স, আয়া ও ওয়ার্ড বয়রা আমাদের সঙ্গে যে ব্যবহার করেন, তা অবাক হওয়ার মতো। করোনা ছোঁয়াচে রোগ। কিন্তু রোগীদের তো অতি প্রয়োজনীয় সেবাটা নিরাপদ দূরত্বে থেকে হলেও দিতে হবে। এখন অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা সে প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।’ সিলেটে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। একই সঙ্গে বাড়ছে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীও। করোনা চিকিৎসায় হাসপাতাল ও আইসোলেশন সিট বাড়লেও সংকট রয়েছে আইসিইউর। করোনা চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট সরকারি হাসপাতালে আইসিইউর সিট না পেয়ে গুরুতর অসুস্থ রোগীরা পড়ছেন বিপাকে। ব্যয়বহুল হওয়ায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা সাহস করতে পারছেন না বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার। শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের আরএমও ডা. সুশান্ত কুমার মহাপাত্র জানান, হাসপাতালের ওয়ার্ডে মাত্র কয়েকটি সিট খালি আছে। কিন্তু আইসিইউর কোনো সিট খালি নেই। ফলে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বা বাইরে থেকে করোনা আক্রান্ত কোনো গুরুতর অসুস্থ রোগী এলে তাকে আইসিইউতে ভর্তির সুযোগ নেই। শুরুতে করোনা আক্রান্ত বা উপসর্গযুক্ত রোগী কোনো বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা না হলেও বর্তমানে দুটি হাসপাতালে কভিড ইউনিট খোলা হয়েছে। কিন্তু হাসপাতাল দুটির আইসিইউর বিল আকাশচুম্বী হওয়ায় মধ্যবিত্তরা সেখানে ভর্তি হওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। ফলে কোনো রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হলেই তাকে নিয়ে আসা হচ্ছে শামসুদ্দিন হাসপাতালে। কিন্তু সিট সংকটের কারণে আইসিইউ বরাদ্দ দিতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। খুলনায় অক্সিজেন সংকটে করোনা রোগীর চিকিৎসায় ভোগান্তি বাড়ছে। ডেডিকেটেড হাসপাতা?লের ১০টি আইসিইউ বেডের সবকটিতে মুমূর্ষু রোগী ভর্তি রয়েছে। এ অবস্থায় নতুন কাউকে সেখানে ভর্তির সুযোগ নেই। লিকুইড অক্সিজেন প্লান্ট না থাকায় রোগীকে ওয়ার্ডে রেখে অক্সিজেন সরবরাহে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। সেই সঙ্গে মুমূর্ষু রোগীর সেবায় আইসিইউর পরিপূরক হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলাও চালু করা যায়নি। অপরদিকে সরকারি হাসপাতালে স্থান সংকুলান না হওয়ায় খুলনার বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তির সিদ্ধান্ত হলেও তাতে অনীহা প্রকাশ করেছে হাসপাতাল ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। তবে আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে প্রশাসন। খুলনা জেলা সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ বলেন, খুলনার বেসরকারি গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও আদ-দ্বীন হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসায় শয্যা প্রস্তুত রাখতে বলা হলেও তারা অবকাঠামো সংকটসহ নানা সমস্যার কথা বলছেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে চাপ কমছে। কার্যত বর্তমানে এখানে মুমূর্ষু রোগীরা বেশি আসছে। তবে ভর্তি রোগীদের অনেক চাহিদা থাকে। সব চাহিদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পূরণ করতে পারে না। ফলে অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর