বৃহস্পতিবার, ৯ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

টেস্ট নিয়ে যত প্রতারণা

মাহবুব মমতাজী

টেস্ট নিয়ে যত প্রতারণা

নমুনা সংগ্রহের সময় রোগীর বাহ্যিক উপসর্গ দেখে একটা ধারণা ফলাফল তৈরি করতেন। করোনার বাহ্যিক উপসর্গ দেখা দিলে টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ উল্লেখ করা হতো। আর না দেখা দিলে তার রিপোর্টে নেগেটিভ উল্লেখ করা হতো। অথচ তাদের নেই কোনো ল্যাব। কম্পিউটারে ফলাফল লিখে ই-মেইলে তা রোগীর কাছে পাঠিয়ে দিতেন। ইতিমধ্যে ৩৭ জনকে এমন ভুয়া কভিড-১৯ টেস্ট রিপোর্ট জানিয়েছিলেন হুমায়ুন কবির-তানজীনা পাটোয়ারী দম্পতি।

রাজধানীর আশকোনায় ছোট একটি ঘরে চলত তাদের করোনা টেস্টের নামে প্রতারণার কর্মযজ্ঞ। এদের সূত্র ধরেই জোবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (জেকেজি হেলথ কেয়ার) নামে একটি প্রতিষ্ঠানেরও ভুয়া টেস্টের তথ্য বেরিয়ে আসে। এ ঘটনার দুই সপ্তাহ পার হতে না হতেই টেস্ট না করেই করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়াসহ ভয়ংকর সব নানা অভিযোগে সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে রাজধানীর উত্তরা ও মিরপুরে রিজেন্ট হাসপাতাল এবং উত্তরায় রিজেন্ট গ্রুপের প্রধান কার্যালয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানিয়েছে, করোনার টেস্টের নামে প্রতারণায় জড়িতদের একটি তালিকা তাদের কাছে রয়েছে। এদের ধরতে একে একে অভিযান পরিচালনা করবেন তারা।

করোনার কিছু উপসর্গ দেখা দিলে জুনের শুরুতে বেসরকারিভাবে টেস্ট করার জন্য অনলাইনে হুমায়ুন কবির-তানজীনা পাটোয়ারী দম্পতির সঙ্গে যোগাযোগ করেন রাজধানীর তেজগাঁওয়ের এক ব্যক্তি। পরদিনই তানজীনা পাটোয়ারী তার বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে যান। তার রিপোর্ট নেগেটিভ আসে বলে জানানো হয়। বিষয়টি তার বিশ্বাস না হওয়ায় তিনি সরকারিভাবে আবার টেস্ট করান। প্রায় এক সপ্তাহ পর তার রিপোর্ট পজিটিভ আসে। ২২ জুন ঘটনা তদন্তের জন্য আবেদন করেন ওই ভুক্তভোগী। তদন্তে নেমে অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পায় তেজগাঁও থানা পুলিশ। এর পরই জেকেজি হেলথ কেয়ারের বিরুদ্ধে ভুয়া টেস্টের অভিযোগ ওঠার পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রমাণ পেয়ে সেটি বন্ধ করে দেয়। আটকও করা হয় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আরিফ চৌধুরীসহ চারজনকে। তবে রিজেন্ট মালিককে আটক না করা গেলেও একই ধরনের প্রতারণার অভিযোগে ৬ জুলাই হাসপাতালটির আটজন কর্মকর্তাকে আটক করেছে র‌্যাব। কভিড-১৯ মহামারীর ৭০ দিন পরই দেশে ধরা পড়া শুরু করে করোনার সার্টিফিকেট বাণিজ্যের চক্র। এরপর থলের বিড়াল বেরিয়ে আসার মতো একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে টেস্টের নামে প্রতারণার নিত্যনতুন তথ্য। প্রতারকদের এমন কৌশলে ধরাশায়ী হচ্ছেন শিক্ষিত-অশিক্ষিত অনেকেই। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার চাকরিজীবীরাও এদের খপ্পরে পড়েছেন। মহামারী করোনাভাইরাসের নেগেটিভ রিপোর্টের পাশাপাশি পজিটিভ রিপোর্টও বিক্রি হয়। সরকারি-বেসরকারি অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনা আক্রান্ত না হয়েও ভাইরাসের পজিটিভ সনদ নিয়েছেন। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতারক চক্র জাল করোনা সনদ বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সম্প্রতি পুলিশ ও র‌্যাবের হাতে এসব প্রতারক চক্রের বেশ কয়েকজন ধরা পড়েন। তাদের কর্মকান্ডে রীতিমতো হতবাক স্বয়ং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এদিকে করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই মনগড়া রিপোর্ট সরবরাহের দায় স্বীকার করে ২৪ জুন জবানবন্দি দিয়েছেন তানজীনা পাটোয়ারী ও তার স্বামী হুমায়ুন কবির। পুলিশের ভাষায়, তারা বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে জনপ্রতি ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়েছেন। ১৫ জুন রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এলাকা থেকে করোনার জাল সার্টিফিকেট বিক্রির অভিযোগে ফজল হক, শরিফ হোসেন, জামশেদ ও লিয়াকত আলীকে গ্রেফতার করেন র‌্যাব-৩ সদস্যরা। তাদের কাছ থেকে করোনার বেশ কিছু জাল সার্টিফিকেট, দুটি কম্পিউটার, দুটি প্রিন্টার ও দুটি স্ক্যানার উদ্ধার করা হয়। ওই চক্রটি এরই মধ্যে করোনার দুই শতাধিক জাল সার্টিফিকেট বিক্রির কথা স্বীকার করেছে। এর আগে ৬ জুন ঢাকার অদূরে সাভারের গেন্ডা এলাকা থেকে করোনার জাল সার্টিফিকেট বিক্রির অভিযোগে আবু সাঈদ ও রাজু নামে দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা পোশাকশ্রমিকদের কাছে করোনার নেগেটিভ ও পজিটিভ সার্টিফিকেট বিক্রি করে আসছিলেন। তবে পোশাক কারখানা এলাকায় জাল সার্টিফিকেটের দাম কম। সেখানে সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকায় সার্টিফিকেট বিক্রি হচ্ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জুনের শুরু থেকে মহামারী করোনাভাইরাসের জাল সার্টিফিকেটের জমজমাট ব্যবসা চলতে থাকে। প্রতারক চক্র ১ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন হাসপাতাল, করোনা টেস্টিং সেন্টারের সিল, চিকিৎসকের নাম, স্বাক্ষর এবং করোনা সার্টিফিকেটের স্টাইল জাল করে ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট দিচ্ছে। এই প্রতারক চক্র শুধু নেগেটিভ নয়, দিচ্ছে পজিটিভ সার্টিফিকেটও। এই পজিটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে কেউ কেউ আবার অফিসে না গিয়ে বাসায় ছুটি কাটানোসহ নানা সরকারি-বেসরকারি সুবিধা নিচ্ছেন। ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে এ চক্র সক্রিয়।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর