রবিবার, ১২ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

টেস্ট প্রতারণায় ইমেজ সংকটে দেশ

ঝুঁকিতে পড়েছে লাখ লাখ প্রবাসী

মির্জা মেহেদী তমাল

ঢাকা থেকে করোনার নেগেটিভ সনদ নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যাত্রীদের ফের পরীক্ষায় করোনাভাইরাস পজিটিভ পাওয়ার পর বাংলাদেশের সঙ্গে ফ্লাইট চলাচল বন্ধের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। তালিকায় যোগ হচ্ছে নিত্যনতুন দেশের নাম। সর্বশেষ এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে ইতালি। এর আগে একই কারণে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীনও বাংলাদেশের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আর এ খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। করোনা টেস্ট প্রতারণায় চরম ইমেজ সংকটে এখন বাংলাদেশ। ঝুঁকিতে পড়েছে লাখ লাখ প্রবাসী।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, ইতিমধ্যে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা র‌্যাব তদন্ত করে ঢাকার রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে করোনা পরীক্ষার হাজার হাজার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে। এমনকি নমুনা না নিয়ে কিংবা নমুনা নিয়ে ফেলে রেখে টাকার বিনিময়ে মনগড়া রিপোর্ট দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। সে জন্যই আজ ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, বাংলাদেশিরা আলোচিত এবং বহু সমালোচিত। দ্রুত সমস্যা অর্থাৎ নমুনা পরীক্ষা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিতে না পারলে আরও অনেক দেশ বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জানা গেছে, লকডাউনে বন্ধ হয়ে থাকা আকাশপথ পুনরায় খুলে দেওয়ার পর আশার সঞ্চার হয়েছিল, উড়োজাহাজ উড়বে, বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হবে বিভিন্ন দেশের। আটকে পড়া মানুষগুলো ফিরে যাবে আবার। কিন্তু হলো উল্টো। বাংলাদেশের সঙ্গে ফ্লাইট বাতিল করে দিয়েছে ইতালি সরকার। যেখানে দেশটি জয় করছিল করোনাকে, সেখানে করোনার পুনর্জীবন দিচ্ছেন কতিপয় বাংলাদেশি। এই বাংলদেশিরা ফিরে গেছেন, নিয়ে গেছেন করোনা নেগেটিভ সনদ। সে জন্যই আজ সারা ইতালিতেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, বাংলাদেশিরা আলোচিত এবং বহু সমালোচিত। সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনাটি ঘটেছে ৮ জুলাই। কাতার এয়ারওয়েজের একটা বিমানের ১২৫ জন বাংলাদেশি আরোহী ইতালিতে প্রবেশ করতে পারেননি। ইতালির স্বাস্থ্যবিভাগ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই দিনই যাত্রীদের তারা ফেরত পাঠায়।

বিমান ও পর্যটন সংক্রান্ত ম্যাগাজিন দ্য বাংলাদেশ মনিটরের সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলম বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন প্রতিটি দেশ এবং এয়ারলাইনস তীক্ষè নজর রাখছে করোনা টেস্ট নিয়ে ঢাকায় কী হচ্ছে সেটার দিকে। তিনি বলছেন, দ্রুত এমন কোনো ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে বিদেশগামীরা করোনা পরীক্ষা করে সঠিক রিপোর্ট নিয়ে বিমানবন্দরে যেতে পারেন। না হলে বড় চাপে পড়তে পারে বাংলাদেশ। কারণ বিমানবন্দরে চার মাসেও কার্যকর স্ক্রিনিং ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। আবার টেস্ট নিয়েও দুর্নীতি বা অনিয়ম চলতে থাকলে এভিয়েশনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞায় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হতে পারে।

সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, অনেক দেশই করোনার খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এখন সংক্রমণ কমিয়ে আনার দিকে। তারা কোনোভাবেই চাইবে না অন্য দেশ থেকে করোনা রোগী গিয়ে তাদের বিপাকে ফেলুক। তিনি বলেন, বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলো এসব নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। তারা আমেরিকা, ব্রিটেনকেও ছেড়ে কথা বলছে না। তাই বাংলাদেশের আরও সতর্ক হওয়ার বিকল্প নেই। পাশাপাশি সারা বিশ্বেই এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি সংকটে। তারাও চাইবে না ঢাকায় এসে তারা বিপদে পড়ুক। তাই করোনা টেস্ট হতে হবে প্রশ্নমুক্ত এবং বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য। না হলে বড় ধরনের এমবার্গো (নিষেধাজ্ঞার)-এর সামনেও পড়তে হতে পারে। তিনি বলেন, সরকার ২/৩টি জায়গা নির্ধারণ করতে পারে বিদেশগামীদের নমুনা পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সেই রিপোর্ট যাত্রীর পাশাপাশি ইমিগ্রেশন ও বিমান সংস্থার হাতে চলে যাওয়া উচিত। এটি করলে চলমান ভাবমূর্তি সংকট থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ তৈরি হতে পারে। জানা গেছে, গত ২১ মার্চ থেকে চীন ছাড়া বাকি সব গন্তব্যে ঢাকা থেকে ফ্লাইট বন্ধ করা হয় করোনা পরিস্থিতির জের ধরে। পরে আবার ভাড়া করা বা বিশেষ বিমান চালু হলেও নতুন করে সেটিও বন্ধ করেছে জাপান, কোরিয়া ও ইতালি। ১০ জুন জাপানে বিমানের একটি ফ্লাইটে যাওয়া যাত্রীর শরীরে মারণঘাতী ভাইরাস পাওয়া যাওয়ার পর জাপান বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ১১ জুন চীনের চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনসে এবং একই দিনে দক্ষিণ কোরিয়ায় ঢাকা থেকে যাওয়া একটি বিশেষ ফ্লাইটের যাত্রীর শরীরের করোনা ধরা পড়ে। আরব আমিরাত বিমান বাংলাদেশকে ফ্লাইট চালুর অনুমতি দিয়ে পরে আবার তা স্থগিত করেছে। তবে গত ১৫ জুন থেকে যুক্তরাজ্য ও কাতারের সঙ্গে বিমান চলাচলের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। যদিও ইতালিতে ৬ জুলাই ২১ জন যাত্রীর শরীরে করোনা পাওয়ার পর তুমুল শোরগোল শুরু হয়। ইতিমধ্যে এক সপ্তাহের জন্য ফ্লাইট নিষিদ্ধ করেছে ইতালি। এ সময় কোনো চার্টার্ড বিমানও বাংলাদেশ থেকে যেতে পারবে না। এরপর তুরস্ক কর্তৃপক্ষ ১৫ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে সব ফ্লাইট যোগাযোগ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে টেস্ট নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের খবরে আরও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এর মাশুল হিসেবে বিশ্ব থেকে ক্রমশ বাংলাদেশ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

সর্বশেষ খবর