শনিবার, ১৮ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

কী হয়েছিল খুলনায়

গোলাগুলিতে তিনজন নিহত একজনকে পিটিয়ে হত্যা

সামছুজ্জামান শাহীন, খুলনা

কী হয়েছিল খুলনায়

সংঘর্ষের পর গতকাল একটি বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা

খানজাহান আলী থানার মশিয়ালীতে সংঘর্ষ ও গুলিবিনিময়ের ঘটনায় আরও দুজন নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন সাইফুল ইসলাম (২৭) মারা যান। এছাড়া ক্ষিপ্ত এলাকাবাসী প্রতিপক্ষের জিহাদ নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করেছেন। এর আগে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে সংঘর্ষে ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নজরুল ইসলাম ফকির (৬৫) ও গোলাম রসুল (৩৫) নিহত হন। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার কানাই লাল সরকার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে হত্যাকারী সন্দেহে মশিয়ালী গ্রামের মৃত হাচান আলী শেখের ছেলে শেখ জাকারিয়া হোসেনের বসতবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। মশিয়ালী গ্রাম ও আশপাশের আটরা-গিলাতলা এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে স্থানীয় বাসিন্দা আলীম জুট মিলের শ্রমিক নেতা আবদুল হামিদ বলেন, গুলিবর্ষণের ঘটনায় জড়িত শেখ জাকারিয়া হোসেন ও তার দুই ভাইয়ের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ ছিলেন। তারা এলাকায় অত্যাচার, জুলুম, চাঁদাবাজি ও সুদের ব্যবসা করেন। তাদের কারণে অনেক লোক এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এ হত্যার পর এলাকাবাসী তাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছেন। তিন ভাই কয়েক কোটি টাকা খরচ করে এলাকায় যে তিনটি বাড়ি তৈরি করেছেন, ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ওইসব বাড়ি ও তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দিয়েছে। ঘটনার পর তিন ভাই ও তাদের পরিবার রাতেই এলাকা ছেড়েছে।

যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত : স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার মশিয়ালী গ্রামে বন্দুকের গুলিসহ মুজিবর শেখকে পুলিশে ধরিয়ে দেন খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগ নেতা জাকারিয়া ও তার ভাই খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের নেতা জাফরিন। মুজিবরকে গ্রেফতারের বিষয়ে এলাকাবাসী জাকারিয়াকে জিজ্ঞাসা করতে গেলে তাদের বাড়ির সামনে কথাকাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে জাকারিয়া ও জাফরিনের লোকজন স্থানীয়দের ওপর গুলিবর্ষণ করেন। এতে ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মশিয়ালীর মৃত বারিক শেখের ছেলে নজরুল ফকির ও ইউনুচ আলীর ছেলে গোলাম রসুল নিহত হন। এ সময় একই এলাকার সাইদুল শেখের ছেলে সাইফুল ইসলামসহ আরও সাতজন গুলিবিদ্ধ হন। তাদের রাতে খুমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাতে সাইফুল মারা যান। এখানে আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন আফসার শেখ (৬৫), ইব্রাহিম শেখ (২৬), জুয়েল শেখ (৩৫), রানা শেখ (২২), রবি শেখ (৪০) ও শামীম শেখ (২৫)। এদিকে এ ঘটনার পর উত্তেজিত জনতা জাকারিয়া হোসেনের বসতবাড়িতে হামলা চালায়। রাতে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করে জাকারিয়ার বসতবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বন্দুকের গুলিসহ আটক মুজিবরকে রাতে ছেড়ে দেয় পুলিশ। তবে রাত দুইটার দিকে বিক্ষুদ্ধ জনতা জাকারিয়ার সহযোগী মোকসেদ আলীর ছেলে জিহাদ শেখকে (৩০) আটক করে পিটিয়ে হত্যা করে। খানজাহান আলী থানার অফিসার ইনচার্জ মো. শফিকুল ইসলাম জানান, সংঘর্ষের খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ হত্যায় জড়িত সন্দেহে জাহাঙ্গীর নামের একজনকে আটক করেছে পুলিশ।

কে এই জাকারিয়া : স্থানীয়দের ওপর গুলি ও হামলার ঘটনায় নাম উঠে আসা মশিয়ালী গ্রামের মৃত হাচান আলী শেখের ছেলে শেখ জাকারিয়া হোসেন খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক ও আলীম জুট মিলের সিবিএ নেতা। তার ভাই জাফরিন হোসেন খুলনা নগর ছাত্রলীগের বহিষ্কৃৃত সহ-সভাপতি। জানা যায়, সম্প্রতি মশিয়ালী আলিয়া মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতির পদ থেকে এলাকাবাসীর চাপের মুখে জাকারিয়া হোসেনকে পদত্যাগ করতে হয়। এ ঘটনার জের ধরে স্থানীয়দের সঙ্গে তার বিরোধের সূত্রপাত হয়। বৃহস্পতিবার রাতে ঘটনাস্থলে জাকারিয়া ও তার ভাই জাফরিন গুলি ছোড়েন বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। এদিকে এ ঘটনার পর জাকারিয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক মুন্সি মাহবুব আলম সোহাগ। বন্দুকের গুলিসহ আটক হওয়া মুজিবর জানান, ‘এলাকায় জাকারিয়া সুদখোর হিসেবে পরিচিত। এ ধরনের মানুষ মসজিদ, এতিমখানার সভাপতি পদে থাকতে পারে না। এলাকাবাসী তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুললে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তবে এর প্রতিশোধ নিতে ঘরের মধ্যে বন্দুকের গুলি দিয়ে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাকে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করায়।’ 

এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি : বৃহস্পতিবার রাতে গুলিবিনিময়, অগ্নিসংযোগের পর গতকাল এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীকে বিভিন্ন স্থানে জড়ো হয়ে দফায়-দফায় বিক্ষোভ মিছিল করতে দেখা যায়। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। একই সঙ্গে কাউকে আইন হাতে তুলে না নেওয়ার জন্য মাইকে অনুরোধ করছে পুলিশ। মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবির মোবাইল ফোনে স্থানীয়দের উদ্দেশে বলেছেন, হত্যাকারীদের গ্রেফতার না করা পর্যন্ত কোনো পুলিশ ব্যারাকে ফিরবে না।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর