শনিবার, ১৮ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ আর নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ আর নেই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। গতকাল ভোরে রাজধানীর ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। বাদ জুমা কাঁটাবন ঢাল মসজিদে প্রথম জানাজা এবং বাদ আসর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে আরেক দফা জানাজা শেষে সন্ধ্যা ৭টায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে স্ত্রীর পাশে তাঁকে দাফন করা হয়েছে। তাঁর স্ত্রী সেলিমা আহমদ ২০১৬ সালে মারা যান। তাঁর দুই মেয়ে অধ্যাপক দিলরুবা শওকাত আরা ইয়াসমিন ও অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন। আর দুই ছেলের মধ্যে জিয়া হাসান ইবনে আহমদ সরকারি কর্মকর্তা, তানভীর ইকবাল ইবনে আহমদ চিকিৎসক। ১৯৯২-৯৬ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করা অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ সর্বশেষ ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের (ইউডা) উপাচার্য ছিলেন। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের মৃত্যুর খবরে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের অনেকেই এমাজউদ্দীনের এলিফ্যান্ট রোডের বাসভবনে ছুটে যান। ছুটে যান বিএনপির নেতা-কর্মীরাও।

বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ জানান, স্যার বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়লে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। ভোর পৌনে ৬টায় তিনি আইসিইউতে মারা যান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান তাঁর শোকবার্তায় বলেন, একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। বয়োজ্যেষ্ঠ এই শিক্ষাবিদ মৃদুভাষী ও সৌজন্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। শিক্ষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভুঁইয়া স্বাক্ষরিত এক শোকবার্তায় বলা হয়, তাঁর মৃত্যুতে জাতি এক মেধাবী সন্তানকে হারাল। শিক্ষা ও গবেষণায় তাঁর অবদানের কথা আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। গভীর শোক জানিয়ে পৃথক বিবৃতি দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ।

বিএনপিতে সরাসরি কোনো পদে না থাকলেও তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার একজন পরামর্শদাতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন নিয়ে একটি বইও লিখেছেন। বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গঠিত ‘শত নাগরিক কমিটি’র সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা, মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা, তুলনামূলক রাজনীতি : রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, বাংলাদেশে গণতন্ত্র সংকট, সমাজ ও রাজনীতি, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও জাতীয় নিরাপত্তাসহ অর্ধশতাধিক বই লিখেছেন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে তাঁর বই সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়।

মৃত্যু সংবাদ শুনে তাঁর বাসায় যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্মমহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলসহ দলের নেতা-কর্মীরা। সেখানে দলের পক্ষ থেকে শবাধারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন মির্জা ফখরুল। এ সময় তিনি কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পর মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, তিনি এভাবে হঠাৎ চলে যাবেন আমরা কেউ বিশ্বাস করতে পারছি না। কয়েকদিন আগেও আমরা তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীর ভার্চুয়াল আলোচনা সভায়ও যোগ দেন তিনি। তাঁর এ চলে যাওয়া আমাদের জন্য একটি বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি করল, যা পূরণ হওয়ার নয়। আমরা দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

মির্জা ফখরুল এমাজউদ্দীন আহমদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাঁদের সমবেদনা জানান। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সদরুল আমিন, কবি আবদুল হাই শিকদার, শায়রুল কবীর খান উপস্থিত ছিলেন।

অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, জমিরউদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু গভীর শোক প্রকাশ করেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু, মো. শাহজাহান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু, সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, তাবিথ আউয়াল, ইশরাক হোসেন, শেখ রবিউল আলম রবিসহ বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাও গভীর শোক প্রকাশ করেন। এ ছাড়া সাবেক রাষ্ট্রপতি বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি, সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার এমপি, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান ও সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, ভাসানী অনুসারী পরিষদ সভাপতি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও মহাসচিব শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, ২০-দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, এনপিপি সভাপতি ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, এলডিপি একাংশের সভাপতি আবদুল করিম আব্বাসী, মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, ন্যাপের জেবেল রহমান গানি, গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ বিএনপি সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার, ড্যাব সভাপতি ডা. হারুন আল রশিদ, মহাসচিব ডা. আবদুস সালাম, জাসাস সভাপতি ড. মামুন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক চিত্রনায়ক হেলাল খান এবং বিএনপিপন্থি সাংবাদিক সংগঠন বিএফইউজে, ডিইউজেসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন শোক জানিয়ে পৃথক বিবৃতি দিয়েছেন।

দুই দফা জানাজা ও দাফন : কাঁটাবন এলাকায় ঢালের মসজিদে বাদ জুমা এমাজউদ্দীন আহমদের প্রথম জানাজায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ এলাকার মুসল্লিরা অংশ নেন। বাদ আসর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণের জানাজায় ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান, শিক্ষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক লুৎফর রহমান, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক নিজামুল হক ভুঁইয়া, অধ্যাপক ফেরদৌস হোসেন, অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী, অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান খান, অধ্যাপক আবুল কালাম সরকার, অধ্যাপক ইস্রাফিল প্রামাণিক রতন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, হাবিবুর রহমান হাবিব, সাবেক ডাকসু জিএস খায়রুল কবির খোকন, সাবেক এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিব, ডাকসু ভিপি নুরুল হক নূর, যুবদল সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, যুগ্মসম্পাদক নূরুল ইসলাম নয়ন, ছাত্রদল সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব প্রমুখ।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমাজউদ্দীনের লাশ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স মিরপুর বুদ্ধিজীবী গোরস্থানের উদ্দেশে রওনা দেয়। সেখানে স্ত্রীর কবরের পাশে শায়িত করা হয় এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে। এর আগে সজল নয়নে প্রয়াত বাবাকে বিদায় জানান প্রিয় দুই মেয়ে অধ্যাপক দিলরুবা শওকাত আরা ইয়াসমিন ও অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন এবং ছেলে জিয়া হাসান ইবনে আহমদ, পালিত পুত্র অমরচন্দ্র মিস্ত্রি। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক আমিনুল হক, বিএনপি নেতা সাবেক কমিশনার মাসুদ খান প্রমুখ।

জীবনবৃত্তান্ত : রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯৩২ সালে অবিভক্ত বাংলার মালদহে। ভারত ভাগের পর তাঁর পরিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে আসে। শিবগঞ্জের আদিনা সরকারি ফজলুল হক কলেজ ও রাজশাহী কলেজে পড়ালেখা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। স্নাতকোত্তর শেষ করে রাজশাহী কলেজে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তাঁর পেশাজীবনের শুরু। পরে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে এসে ’৭০ সলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন। এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডক্টরেট করেন কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা এমাজউদ্দীন আহমদ প্রক্টর-প্রোভিসির দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৯২ সালে তিনি উপাচার্যের দায়িত্ব পান। ’৯৬ সাল পর্যন্ত ওই পদে ছিলেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির প্রথম সরকারের সময় ১৯৯২ সালে শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য একুশে পদক লাভ করেন এমাজউদ্দীন আহমদ। ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে লিখেছেন ৫০টির বেশি বই। পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন তিনি।

সর্বশেষ খবর