শনিবার, ১৮ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা
মন্তব্য কলাম

দুই ঘণ্টা বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

দুই ঘণ্টা বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু

মানুষের জীবন অতীব মূল্যবান। মানুষসহ সব প্রাণীকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। মৃত্যু যখন প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে হয়, তখন কারও কিছু বলার থাকে না, কেননা মৃত্যু ঠেকানো তো কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু অপমৃত্যুর কারণে জীবনের যবনিকা ঘটলে তখন মানুষের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হওয়াই স্বাভাবিক। পার্ক ভিউ হাসপাতালের হৃদয়বিদারক ঘটনা জনমনে সে ধরনের প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করেছে। খবরটি আমার গোচরে আসার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল একই ধরনের অপমৃত্যু ঘটানোর কারণে আমি দেশের অতি পরিচিত ল্যাবএইড নামক এক বেসরকারি হাসপাতালের মালিকদের সারা দিন হাই কোর্টের কাঠগড়ায় বন্দী করে রেখেছিলাম এবং মৃত ব্যক্তির পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে আদেশ দ্বারা বাধ্য করেছিলাম। এটি ২০১২ সালের কথা। আমি তখন হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি। এক দিন প্রত্যুষে একটি বিশ্বস্ত সংবাদপত্রে জেনেছিলাম মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী নামক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক ডায়রিয়া রোগ নিয়ে ল্যাবএইড হাসপাতালে গেলে দুই ঘণ্টা তাকে কেউ ছুঁয়েও দেখেননি, ফেলে রেখেছিল অপেক্ষমাণ এলাকায়। দুই ঘণ্টা পর তার মৃত্যু হয়। অধ্যাপক চক্রবর্তীর সঙ্গে গিয়েছিলেন তার এক চিকিৎসক ভাগিনা। আদালতে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, তার মামা ডায়রিয়ার কারণে অবশেষে জলশূন্যতায় মারা গিয়েছিলেন। তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে কালক্ষেপণ না করে যথাসময়ে তার চিকিৎসা শুরু করলে হয়তো তিনি বেঁচে যেতেন, কারণ তখন তার তাৎক্ষণিক প্রয়োজন ছিল স্যালাইন প্রয়োগের। ল্যাবএইড মালিকদের সারা দিন কাঠগড়ায় আটকিয়ে রেখে দিনের শেষে আদেশ দিলাম ৫০ লাখ টাকা সঙ্গে সঙ্গে চক্রবর্তী পরিবারের হাতে তুলে দিতে। সঙ্গে এই নির্দেশও দিয়েছিলাম যে তারা যতক্ষণ ৫০ লাখ টাকা ওই পরিবারকে না দেবেন ততক্ষণ তাদের বন্দী করে রাখা হবে বা জেলে পাঠানো হবে। ওই আদেশে ভীত হয়ে ল্যাবএইড মালিকরা তাৎক্ষণিক চেক বই এনে হাই কোর্টের কাঠগড়ায় থাকা অবস্থাতেই ৫০ লাখ টাকা মিসেস চক্রবর্তীর হাতে তুলে দিলে আমরা তাদের বন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেই। আমাদের ইচ্ছা ছিল ক্ষতিপূরণের পরিমাণ এক কোটিতে নির্ধারণ করা। কিন্তু ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাহেব ল্যাবএইড থেকে ৫০ লাখ টাকা আদায় করায় আমরা ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ৫০ লাখে নামিয়েছিলাম। তবে একই সঙ্গে পুলিশের আইজিকে নির্দেশ দিয়েছিলাম ল্যাবএইড মালিকদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩০৪/(ক) ধারায় নরহত্যার মামলার জন্য উপযুক্ত তদন্ত করার। এর কিছু সময় পরই আমি আপিল বিভাগে পদোন্নতি পাওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে নরহত্যার মামলার তদন্তের অগ্রগতি দেখার সুযোগ পাইনি। সেই মামলায় আমার সঙ্গে দ্বিতীয় বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর। এই নির্দেশের পর কয়েকজন বেসরকারি হাসপাতাল মালিক ধর্মঘটে যাওয়ার ভয় দেখালে আমরা অ্যাটর্নি জেনারেল সাহেবকে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছিলাম, এ ধরনের দুঃসাহস কেউ দেখালে তাদের আদালত অবমাননার অভিযোগে সরাসরি জেলে পাঠাব, সে যেই হোক না কেন। এরপর আর তারা ধর্মঘট করার দুঃসাহস দেখাননি। অবহেলার কারণে ইবনে সিনা হাসপাতালে দুই শিশুর মৃত্যু হলে যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীসহ ইবনে সিনার সব মালিককে হাই কোর্টের কাঠগড়ায় সারা দিন বন্দী রেখে একই ধরনের আদেশ দিয়েছিলাম।

অনেকেই আইনি অবস্থা জানতে চান। ফৌজদারি এবং দেওয়ানি উভয় ধরনের আইনই অত্যন্ত স্পষ্ট। দন্ডবিধির ৩০৪(ক) অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির অবহেলা বা গাফিলতির কারণে কারও মৃত্যু ঘটলে অবহেলাকারী ৩০৪(ক) ধারায় নরহত্যার দায়ে অপরাধী। তবে এই অপরাধ ৩০২ ধারায় খুনের অপরাধে বিচার্য খুনের অপরাধ থেকে একটু নিম্ন পর্যায়ের নরহত্যা। হাসপাতাল বা চিকিৎসকদের ব্যাপারে আইন হলো- কোনো রোগী হাসপাতালে গেলে হাসপাতালের দায়িত্ব হলো তাকে বিনা অবহেলায় পরীক্ষা করা, চিকিৎসা দেওয়া। সেখানে গাফিলতির কারণে রোগীর মৃত্যু হলে ৩০৪(ক) অপরাধ হয়। দেওয়ানি দায়বদ্ধতা টর্ট নামক আইন দ্বারা পরিচালিত। এই আইনে অবহেলা বা নেগলিজেন্সের কারণে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে, অবহেলাকারী ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। এখানে চুক্তির কোনো প্রয়োজন নেই। টর্টের মামলার উপযুক্ত আদালত মূলত নিম্ন আদালত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যুগ্ম জেলা জজ। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে ভারতের হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট তাদের রিট, অধিক্ষেত্র প্রয়োগ করে টর্টে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ দিচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের হাই কোর্ট, আপিল বিভাগও রিট এখতিয়ারে একই ধরনের আদেশ দিচ্ছে, যার ভিত্তিতেই আমি ল্যাবএইডের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক আদেশ দিয়েছিলাম। আইনের শাসন এবং মানুষের অধিকার রক্ষায় আমাদের হাই কোর্ট সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে বহু বছরের ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটেছে কয়েকটি সাম্প্রতিক আদেশেও, যার একটি হলো ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে। হাই কোর্ট বিভাগ ক্ষতিপূরণের অঙ্ক স্থির করার জন্য আদেশ দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে ওই হাসপাতালের মালিকদের ফৌজদারি দায় তদন্ত ত্বরান্বিত করার জন্য। ওই হাসপাতালে মৃতের লাশ জিম্মি করে আরও একটি স্বতন্ত্র অপরাধ করেছে, যা দন্ডবিধির ২৯৭ ধারা এবং ৫০৩ ধারা শাস্তিযোগ্য। এগুলোর টর্টের আইনেও বিচারযোগ্য। সব বেসরকারি হাসপাতালের জানতে হবে লাশ জিম্মি করে পাওনা আদায় করাও অপরাধ। তাদের পাওনা আদায় করতে হবে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, কোনো লাশ জিম্মি করে নয়। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও উচিত এ ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা নজরে এনে অপরাধী হাসপাতালের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়ার সূচনা করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া এবং একই সঙ্গে ১৯৮২ সালের আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল করা।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

সর্বশেষ খবর