মঙ্গলবার, ২১ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

লাইসেন্সহীন দুই-তৃতীয়াংশ হাসপাতাল

বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ১৭ হাজার ২৪৪, লাইসেন্স আছে মাত্র ৫ হাজারের, তিনজন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে সব হাসপাতাল

জয়শ্রী ভাদুড়ী

লাইসেন্সহীন দুই-তৃতীয়াংশ হাসপাতাল

রাজধানীর উত্তরায় হাসপাতালে অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত -বাংলাদেশ প্রতিদিন

লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চলছে দেশের চিকিৎসাসেবা। দেশে বর্তমানে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ১৭ হাজার ২৪৪টি। এর মধ্যে মাত্র ৫ হাজার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোনো নজরদারি না থাকায় সেবার নামে চলছে ব্যবসা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরসূত্রে জানা যায়, একজন সহকারী পরিচালক ও দুজন মেডিকেল অফিসারের তত্ত্বাবধানে চলে দেশের সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। দেশে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ১৭ হাজার ২৪৪টি। ডিজিটাল লাইসেন্স নবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর পুরো কার্যক্রম আরও স্থবির হয়ে পড়েছে। দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স-১৯৮২০-এর অধীনে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো পরিচালিত হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানাতে নোটিস ও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া ছাড়া কার্যত কিছু করতে পারে না স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক আমিনুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘২০১৮ সাল থেকে লাইসেন্স নবায়নের প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজড করার কার্যক্রম শুরু করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে ৫ হাজারের যথাযথ লাইসেন্স রয়েছে। বাদবাকি প্রতিষ্ঠানগুলো লাইসেন্স নবায়ন করতে আসেনি। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর লাইসেন্স নবায়নের জন্য পরিবেশগত ছাড়পত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিস্তারিত বিবরণ, সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র, কর সার্টিফিকেট এবং অন্যান্য নথি প্রয়োজন হয়। এসব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে পারে না বলে তারা লাইসেন্স নবায়ন করতে পারে না।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক কাজী দীন মোহাম্মদ নুরুল হক বলেন, ‘হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন, অনুমোদন এগুলো স্বাস্থ্য অধিদফতরের রুটিন কাজ। তদন্ত দল হাসপাতাল পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেবে, সে অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিদফতর অনুমোদন দেওয়া/না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে। প্রতিটি হাসপাতাল অনুমোদন দেওয়ার সময় শর্তই থাকে প্রতি বছর লাইসেন্স নবায়ন করার।’ তিনি আরও বলেন, ‘একজন সহকারী পরিচালক ও দুজন মেডিকেল অফিসার দিয়ে দেশের সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তদারকি সম্ভব নয়। এত অল্পসংখ্যক জনবল নিয়ে কখনো প্রত্যাশিত ফল পাওয়া সম্ভব নয়। অনিয়ম, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা নিরসনে হাসপাতাল শাখাকে পূর্ণাঙ্গ বিভাগে পরিণত করা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় আছে বলে আমি মনে করি না। ১৯৮২ সালে যখন অর্ডিন্যান্স জারি হয় তখন ঢাকা শহরে মাত্র দুটি হাসপাতাল ছিল। এ অর্ডিন্যান্সের কারণে এখন অনেক অসাধু বেসরকারি ক্লিনিকের মালিক সুযোগ নিচ্ছেন।’ দেশে মোট বৈধ বেসরকারি হাসপাতালের তালিকায়ও রয়েছে গরমিল। বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তালিকায় দেখা যায়, দেশে বেসরকারি ক্লিনিক রয়েছে ২ হাজার ৭৬১টি এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৪ হাজার ৭০৪টি। অর্থাৎ মোট বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ৭ হাজার ৪৬৫টি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের তালিকার সব হাসপাতালের লাইসেন্স এ বছর পর্যন্ত নবায়ন হয়েছে। তবে আগামী মাসে মেয়াদ পূর্ণ হলে তালিকায় পরিবর্তন আসবে। লাইসেন্স নবায়ন করতে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকার ব্যাপারে তাদেরই জিজ্ঞাসা করতে হবে, এ ব্যাপারে তো আমরা জানি না।’

২০১৮ সাল থেকে বৈধ লাইসেন্স না থাকলেও তেমন কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের। দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্লিনিক। এসব ক্লিনিকের নেই পরিবেশ ছাড়পত্র কিংবা সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র। ২০১৮ সাল থেকে লাইসেন্স নবায়ন প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজড করার সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। ওয়েবসাইটে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংযুক্ত করে আবেদনপত্র জমা দিতে হয়। এরপর স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে আবেদনকারী প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করবেন। সবকিছু সন্তোষজনক হলে লাইসেন্স অনুমোদন ও মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু মাত্র তিনজন কর্মকর্তার পক্ষে এ সার্বিক কাজ সম্পন্ন করতে গিয়ে তৈরি হয়েছে ধীরগতি। একইভাবে জেলা সদরের সার্বিক তত্ত্বাবধানও চলছে ঢিমেতালে। ২০১৪ সালে রিজেন্ট হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি জানা সত্ত্বেও হাসপাতালটির সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের চুক্তির বিষয়টি জনসম্মুখে আসে। এর পর থেকেই বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। গত ৭ জুলাই র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখায় অভিযান চালায় এবং করোনা পরীক্ষার ভুয়া সনদ উদ্ধার করে। এরপর গুলশানের শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অভিযান চালায় র‌্যাব। বেরিয়ে আসে ১১ বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ সার্জিক্যাল সামগ্রী ও নিষিদ্ধ ওষুধ। এ ছাড়া পাওয়া গেছে অনুমোদনহীন কিট ও ভুয়া করোনা রিপোর্টের সনদ। করোনাভাইরাস মহামারীতেও চলছে প্রতারণা ও রোগী ঠকিয়ে ব্যবসা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে উঠে আসছে চিকিৎসাসেবার নামে প্রতারণার ভয়াবহ চিত্র। এ পরিস্থিতির দায় নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মধ্যে দোষারোপ চলছে। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ ই মাহবুব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার এ পরিস্থিতি এক দিনে তৈরি হয়নি। এ দায় যেমন স্বাস্থ্য অধিদফতর এড়াতে পারে না আবার কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও অস্বীকার করতে পারে না। তারা এখন ব্লেম গেমে ব্যস্ত। করোনাভাইরাস মহামারী ঠেকাতে কাদা ছোড়াছুড়ি বাদ দিয়ে সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ হাসপাতালের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।’

 

সর্বশেষ খবর