বুধবার, ২২ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

সর্বনাশা ডায়াগনস্টিক সেন্টার

মনগড়া রিপোর্ট ইচ্ছামাফিক ফি । অনুমোদনের বালাই নেই, নেই মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা । হাতুড়ে টেকনিশিয়ানদের দিয়ে রোগ নির্ণয়

সাঈদুর রহমান রিমন

সরকারি অনুমোদন ছাড়াই দেশজুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার-প্যাথলজি বাণিজ্য। বিশেষ করে রাজধানীর অলিগলি সর্বত্র রোগ নির্ণয়ের নামে সাইনবোর্ডসর্বস্ব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ছড়াছড়ি। বেশির ভাগ ডায়াগনস্টিক ও প্যাথলজি সেন্টারই গড়ে উঠেছে সরকারি অনুমোদন ছাড়া। ইচ্ছামতো নিয়ম-কানুন তৈরি করে বছরের পর বছর রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে এরা। নেওয়া হচ্ছে ইচ্ছামাফিক ফি। হাতুড়ে টেকনিশিয়ানরা অনেক ক্ষেত্রেই দিচ্ছেন মনগড়া রিপোর্ট।

জানা যায়, চিকিৎসাবিদ্যায় অভিজ্ঞতাহীন পিয়াজ, আলু, ঢেউটিন ব্যবসায়ীদের গড়ে তোলা ডায়াগনস্টিক ও প্যাথলজি সেন্টারে হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দিয়েই চলে রোগ নির্ণয়ের সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে অহরহ ঠকাচ্ছেন নিরীহ মানুষকে। একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট দেওয়ারও অসংখ্য নজির রয়েছে। পুরুষের রিপোর্টে তুলে ধরা হয় মেয়েলি রোগের বিবরণ, উল্টো চিত্রও আছে। আবার একই ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য একেক প্রতিষ্ঠানে ধার্য আছে একেক ধরনের ফি। এসব রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। তা সত্ত্বেও ডাক্তাররা নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সরবরাহকৃত স্লিপে টিক মার্ক দিয়ে টেস্ট করাতে রোগী পাঠিয়ে থাকেন। তারা সামান্য জ্বর, ঠান্ডা, কাশির জন্যও ডজন ডজন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা লিখে দিচ্ছেন। আবার রোগী নিজের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্ট করালে ডাক্তার সে রিপোর্ট গ্রহণ করেন না। ডাক্তার তার নির্ধারিত সেন্টার থেকে রোগীকে আবার একই টেস্ট করিয়ে আনতে বাধ্য করেন। বেশি টাকা দিয়ে নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্ট করিয়েও সঠিক রোগ নির্ণয়ের নিশ্চয়তা পান না ভুক্তভোগীরা। কিন্তু ওই সেন্টারগুলো থেকে টেস্ট বাবদ দেওয়া কমিশন নিশ্চিত করার পরই ডাক্তার চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন। এভাবেই সরকারি হাসপাতালের রোগী জিম্মিকারী একশ্রেণির ডাক্তারের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্ট বাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। অভিযোগ তুলেও এসবের প্রতিকার মিলছে না।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডে ৬৫০ স্কয়ার ফুটের একটি বাড়ির নিচতলা। তাতে ছোট ১০টি কামরা নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এখানেই ইসিজি, আলট্রাসনোসহ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে রোগী আসছেন, যেখানে-সেখানে থুথু ফেলছেন, অপেক্ষা করছেন টয়লেটের সামনে রাখা ছয়টি চেয়ারে। রোগীরা নাকে কাপড় চেপে বসে আছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। চিকিৎসকরা বলছেন, এ ধরনের জায়গায় রোগীর রোগ নির্ণয় করবে কী, আরও রোগাক্রান্ত হয়ে ফিরবেন। খুবই দুঃখজনক হলো, তাদের অনেকের কাছেই বৈধ কাগজ আছে। মোহাম্মদপুরের বাবর রোড, হুমায়ুন রোডসহ শ্যামলী এলাকাজুড়ে এ ধরনের হাজারখানেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। হুমায়ুন রোডে টানা রাস্তার দুই পাশে ২৪টি বাড়ির ৯টিরই নিচতলায় ডায়াগনস্টিকের সাইনবোর্ড। আর সরকারি সব হাসপাতালের চিকিৎসকদের ১০-১২টি করে সাইনবোর্ড লাগানো। ধানমন্ডি ও উত্তরার অনেক রোড, অলিগলি জুড়ে শুধু ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজি প্রতিষ্ঠানের ছড়াছড়ি। সেসবের সিংহভাগই অবৈধ। খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই বলছেন, সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই। সারা দেশে বিভিন্ন সময়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন নিয়ে ৭ সহস্রাধিক ডায়াগনস্টিক ও প্যাথলজি সেন্টার গড়ে তোলা হলেও এর মধ্যে ৫ হাজার প্রতিষ্ঠানই নবায়ন না করায় বৈধতা হারিয়েছে। অন্যদিকে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ৩০ হাজারের বেশি রোগ নির্ণয় প্রতিষ্ঠান। শুধু রাজধানীতেই লাইসেন্সধারী ৬৬০টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিপরীতে রয়েছে ৫ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান। ভুঁইফোড় এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল বিভাগটি বরাবরই চরম উদাসীন। পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্রও নেয়নি এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। প্রতিনিয়ত রক্তমিশ্রিত ব্যান্ডেজ, মাংসের টুকরো, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ও অন্যান্য আবর্জনা ফেলা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের আশপাশে, খোলা স্থানেই। নিয়ম অনুযায়ী এগুলো পোড়ানোর কথা। এসব বর্জ্য থেকে সিরিঞ্জসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ধুয়েমুছে আবার ব্যবহার করার অভিযোগও রয়েছে। ফলে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ ঘটছে। অন্যদিকে এ বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে খোলা জায়গায় ফেলে রাখার কারণে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে মারাত্মকভাবে।

হাতুড়ে টেকনিশিয়ানদের মনগড়া রিপোর্ট : প্রতিষ্ঠানের সামনে সুপরিচিত ডাক্তার বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘ তালিকাযুক্ত বিরাট মাপের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হলেও সরেজমিন গিয়ে কাউকে পাওয়া যায় না। জানা যায়, রোগী আকর্ষণের জন্যই শুধু বিশেষজ্ঞদের নাম সাইনবোর্ডে লেখা হয় এবং নাম ব্যবহার বাবদ মাসিক ফি দেওয়া হয় তাদের। সেসব ক্লিনিকে গিয়ে সাইনবোর্ডে লিপিবদ্ধ কাউকে পাওয়া যায়নি। বেশির ভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত সার্টিফিকেটধারী দক্ষ টেকনিশিয়ান পর্যন্ত নেই। সেবার উদ্দেশ্য ছাড়াই নিছক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মনগড়া রিপোর্ট তৈরির মাধ্যমে নিরীহ মানুষকে প্রতারিত করা হচ্ছে অহরহ। অদক্ষ টেকনিশিয়ানের মাধ্যমেই ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে আর ভুলভ্রান্তিও ঘটছে প্রায়ই। ফলে রোগীর জীবন বিপন্নের পাশাপাশি প্রায়ই রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ভুল রিপোর্ট প্রদানের কারণে রোগী মৃত্যুর ঘটনায়ও কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক, কর্মকর্তা বা টেকনিশিয়ানকে কখনো শাস্তি দেওয়ার বিন্দুমাত্র নজির নেই। এ কারণে দিন দিন তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।

নিয়ন্ত্রণহীন সেবা ফি : বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয় রোগীদের থেকে মাত্রাতিরিক্ত ফি আদায় কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। রোগ নির্ণয়ের নানা পরীক্ষার নামে বিভিন্ন কৌশলে রোগী ও স্বজনদের পকেট খালি করেও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ ক্ষান্ত হয় না, উপরন্তু রোগীকে বন্দী রেখে বা লাশ জিম্মি করেও লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে টেস্টের টাকা পরিশোধ করে সর্বস্বান্ত হয়ে চিকিৎসা না নিয়েই বাসায় ফিরতে বাধ্য হন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির রোগীরা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া রেট চার্ট মানে না রাজধানীর কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারই। এর বদলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব রেট চার্ট রয়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন এসব সেবামূল্য আদায়ে রোগীদের জিম্মি করাসহ নানা মাত্রার হয়রানি-অত্যাচার সুদখোর মহাজনদেরও হার মানাচ্ছে। বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্য তালিকা জনসমাগমস্থলে (পাবলিক প্লেস) প্রদর্শনের ব্যাপারে উচ্চ আদালতের কড়া নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু সরেজমিন রাজধানীর কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারেই মূল্য তালিকা টানানো দেখা যায়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর