বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

জবাবদিহি নেই ওষুধ বিক্রিতে

৭১ শতাংশ ফার্মেসির নেই বৈধ কাগজপত্র, মেয়াদোত্তীর্ণ ভেজাল ও নকলে বাজার সয়লাব, নেই পর্যাপ্ত মনিটরিং

জয়শ্রী ভাদুড়ী

জবাবদিহি নেই ওষুধ বিক্রিতে

লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স দিয়ে চলছে ওষুধ বিক্রি। দেশের ৭১ শতাংশ ফার্মেসির লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও নজর নেই ঔষধ প্রশাসনের। ভেজাল, মানহীন ওষুধ ও সামগ্রী বিক্রির তালিকায় রয়েছে নামিদামি মডেল ফার্মেসিগুলোও। ওষুধ বিক্রিতে জবাবদিহি না থাকায় ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে সয়লাব হচ্ছে বাজার, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। ফার্মাসিস্ট ছাড়াই দিনের পর দিন চলছে ফার্মেসি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মীর ইমাম ইবনে ওয়াহেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে তিন ধরনের ফার্মাসিস্ট রয়েছে। প্রথম ধরনের ফার্মাসিস্টরা ‘এ গ্রেড’ভুক্ত। তারা মূলত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। দ্বিতীয় ধরনের ‘বি গ্রেড’ ফার্মাসিস্টরা প্যারামেডিকেল বা আইএইচটি থেকে ডিপ্লোমা করে থাকেন। আরেক ধরনের ফার্মাসিস্ট হচ্ছেন ‘সি গ্রেড’ভুক্ত। এরা মূলত বিভিন্ন জেলা পর্যায়ের ফার্মেসি কাউন্সিলের মাধ্যমে তিন মাস কিংবা স্বল্পমেয়াদি অন্য কোনো ধরনের কোর্স সম্পন্ন করেন। আমাদের দেশে এই ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট বর্তমানে বেশি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা গ্রাম থেকে শহর পর্যায়ে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের ওষুধের দোকান দিয়ে ওষুধ বিক্রি করছেন। কিন্তু যারা এ ওষুধের দোকানগুলো দিচ্ছেন এবং ওষুধ বিক্রি করছেন তাদের মধ্যে অনেকের ডিগ্রি আমরা দেখতে পাই না। অনেক সময় তারা কোর্স সম্পন্ন না করেই বিভিন্ন উপায়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে সার্টিফিকেট অর্জন করেন। এ লাইসেন্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও তারা তাদের ফার্মেসি চালু রাখেন এবং ওষুধ বিক্রি করেন। এটা মূলত আমাদের প্রশাসনিক দুর্বলতা ও নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে হয়ে আসছে। এ বিষয়গুলো মনিটরিং করার দায়িত্ব ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের। তাদের অধীনে চার-পাঁচটি জেলা নিয়ে একজন করে ড্রাগ সুপার রয়েছেন। যিনি ফার্মেসিগুলোর লাইসেন্সসহ অন্যান্য সরকারি বিধিনিষেধ ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তবে এটা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত তত্ত্বাবধান এবং ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের সঠিক বিধিনিষেধের অভাবে গ্রামাঞ্চলে ব্যাঙের ছাতার মতো বিভিন্ন ধরনের ফার্মেসি গড়ে উঠছে।’

ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের ওয়েবসাইটসূত্রে জানা যায়, দেশে এ পর্যন্ত লাইসেন্স নেওয়া ফার্মেসির সংখ্যা ১ লাখ ১৯ হাজার ৭১৪টি। এর মধ্যে নবায়ন করা হয়েছে ৩৪ হাজার ৮৪৪টি। বাকি ৮৪ হাজার ৮৭০টি লাইসেন্স নবায়ন হয়নি, যা মোট লাইসেন্সের ৭১ শতাংশ। ফলে এসব দোকানে ওষুধ মজুদ, প্রদর্শন ও বিক্রয় ১৯৪৬ সালের ড্রাগস রুলস অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। ঠাকুরগাঁও জেলায় লাইসেন্স থাকা ফার্মেসির সংখ্যা দেখা যায় ৪৭টি। এর প্রতিটির লাইসেন্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ। অধিকাংশ ফার্মেসির মেয়াদ এ বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছিল। লাইসেন্সের মেয়াদ পাঁচ মাস আগে শেষ হলেও নবায়ন না করায় কোনো ব্যবস্থা নেননি কর্তৃপক্ষ।

ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের প্রতিবেদনে কেবল দেশের লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। এর বাইরে লাইসেন্সবিহীন দোকান রয়েছে লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের চেয়ে দুই থেকে আড়াই গুণ। একটি খুচরা বা পাইকারি দোকানের ড্রাগ লাইসেন্স নেওয়ার পর তা প্রতি দুই বছর অন্তর নবায়ন করা বাধ্যতামূলক। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নবায়ন করা না হলে বিলম্ব ফি দিয়ে নবায়নের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও লাইসেন্স নবায়ন করছেন না ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকলেও মেয়াদোত্তীর্ণ এসব লাইসেন্স বাতিলে কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। অধিদফতরসূত্রে জানা যায়, খুচরা ওষুধ বিক্রির জন্য দুই ক্যাটাগরির লাইসেন্স দেয় অধিদফতর। একটি হলো মডেল ফার্মেসির, আরেকটি মেডিসিন শপের। মডেল ফার্মেসির জন্য প্রয়োজন হয় ৩০০ ফুটের একটি দোকান, পৌরসভার ভিতরে হলে ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং বাইরে হলে ১ হাজার ৫০০ টাকা। সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যা ব্যাংকে জমা দিতে হয়। এ ছাড়া ট্রেড লাইসেন্সের সত্যায়িত ফটোকপি, মালিকের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, মালিকের ব্যাংক সচ্ছলতার সনদ, ফার্মেসিতে নিয়োজিত গ্র্যাজুয়েট বা এ গ্রেড ফার্মাসিস্টের রেজিস্ট্রেশন সনদের সত্যায়িত ফটোকপি, ফার্মাসিস্টের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, ফার্মাসিস্টের অঙ্গীকারনামা, দোকান ভাড়ার চুক্তিনামা। এ ছাড়া মেডিসিন শপের ক্ষেত্রে ১২০ ফুটের দোকান, ফার্মেসিতে নিয়োজিত বি বা সি গ্রেডের ফার্মাসিস্টের রেজিস্ট্রেশন সনদের সত্যায়িত কপি এবং মডেল ফার্মেসির মতোই অন্যসব সনদ দিয়ে শর্ত পূরণ করলেই দেওয়া হয় ড্রাগ লাইসেন্স।

জানা গেছে, তদারকি না থাকায় নকল, ভেজাল, মানহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিষিদ্ধ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে ফার্মেসিতে। ওষুধের বিজ্ঞাপন না থাকায় কোম্পানি ও সঠিক ওষুধ চেনার উপায় জানতে পারছে না মানুষ। ফলে প্রতারিত হচ্ছে ভোক্তা। নিয়ম অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার এক থেকে তিন মাসের মধ্যে ২০০ টাকা ফি দিয়ে পৌর এলাকার পাইকারি, ১০০ টাকা দিয়ে খুচরা দোকান ও ৫০ টাকায় পৌর এলাকার বাইরের দোকানের লাইসেন্স নবায়ন করা যায়। মেয়াদোত্তীর্ণের তিন থেকে ১২ মাস পর্যন্ত পৌর এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা ৫০০, খুচরা ব্যবসায়ীরা ২০০ আর পৌর এলাকার বাইরের দোকান ১০০ টাকা ফি দিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করতে পারে। এ ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণের ১২ মাসের ঊর্ধ্বে বা পরবর্তী বছরের জন্য পাইকারি দোকান ১ হাজার ও খুচরা দোকানের ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা ফি দিয়ে লাইসেন্স নবায়নের সুযোগ রয়েছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সাবেক পরিচালক জাকির হোসেন রনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সারা দেশে লাইসেন্সধারী ফার্মেসির সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজারের মতো। আর লাইসেন্স ছাড়া ওষুধের দোকান রয়েছে আরও প্রায় দেড় লাখ। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর ও বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির দুর্বলতার কারণে লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বহু ফার্মেসি। এসব প্রতিষ্ঠানে বিক্রি হচ্ছে নকল ওষুধ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধু ফার্মেসির মালিকদের দোষ দিলে হবে না লাইসেন্স দেওয়া প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির বিরুদ্ধে রয়েছে অনেক অভিযোগ। দায় ওষুধ কোম্পানিরও রয়েছে। যেসব নামিদামি ওষুধ কোম্পানির ওষুধ নকল হয় তাদেরও পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এসব অনিয়ম, দুর্নীতি রোধ এবং স্বাস্থ্য খাত ও ওষুধশিল্পকে বাঁচাতে টাস্কফোর্স জরুরি।’

আইন অনুযায়ী ফার্মেসিগুলোয় ট্রেড ও ড্রাগ লাইসেন্স এমনভাবে রাখতে হবে যাতে মানুষ দেখতে পায়। কিন্তু দেশের খুব কমসংখ্যক ফার্মেসিতেই এ নিয়ম মানতে দেখা যায়। সরকার-ঘোষিত মডেল ফার্মেসি ‘লাজ ফার্মা’য় র‌্যাবের অভিযানে বেরিয়ে এসেছে অননুমোদিত ওষুধ ও ইনজেকশন দিয়ে রোগী প্রতারণার চিত্র।

হাতিরপুলের সাফিন-সিজান ফার্মেসির ওষুধ বিক্রতা মিজান উদ্দিন জানান, তার ফার্মাসিস্টের সার্টিফিকেট নেই। দোকানেরও লাইসেন্স তার ভাইয়ের নামে নেওয়া। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এ দোকান চালান। একই লাইসেন্সে বাবুবাজারে তাদের আরেকটি দোকান রয়েছে। সেখানে তার ভাই-ভাতিজা ব্যবসা করেন।

তদারকি না থাকায় নিরাপদে চলছে এসব অবৈধ দোকানে ওষুধের ব্যবসা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর