সোমবার, ২৭ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

বন্যার হুমকিতে রাজধানীর পূর্বাঞ্চল

সবকিছু ঠিক থাকার পরও ইস্টার্ন বাইপাস নির্মাণ না করায় তৈরি হচ্ছে নানামুখী জটিলতা

নিজামুল হক বিপুল ও মানিক মুনতাসির

বন্যার হুমকিতে রাজধানীর পূর্বাঞ্চল

ইস্টার্ন বাইপাসের লোকেশন ম্যাপ

২০ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও আলোর মুখ দেখেনি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঢাকা ইস্টার্ন বাইপাস। কবে নাগাদ এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে তাও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। ফলে প্রতিবছরই বন্যার ঝুঁকিতে থাকছে রাজধানী ঢাকার পূর্বাঞ্চলসহ অন্য এলাকাগুলো। দুই দশকেও প্রকল্পটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় রাজধানীর পূর্বাঞ্চলজুড়ে নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে তুরাগ নদ এবং বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর অতি প্লাবনে ঢাকার পূর্বাঞ্চলে নিয়মিতই বন্যার ঝুঁকি দেখা দেয়। কিন্তু আমলাতন্ত্রিক জটিলতা, নকশা প্রস্তুত না হওয়া, বারবার ডিপিপি পরিবর্তন ও অর্থ সংকটের কারণে রাজধানীর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ফলে বন্যার ঝুঁকির হুঙ্কার থেকেও মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর। আর সামান্য বৃষ্টিতেই নগরীর চারপাশের নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হচ্ছে প্রতিবছর। তবে প্রকল্পের স্টাডি রিপোর্ট তৈরি করার জন্য চলতি মাসেই একটি প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এটি করতে চার মাস সময় লাগবে। এর পরই চূড়ান্ত ডিপিপি তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। রাজধানী ঢাকাকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করতে এই প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও এটি বহুমুখী কাজে ব্যবহৃত হবে। সার্কুলার সড়ক, সার্কুলার রেলপথসহ অন্যান্য কাজে এই বাইপাস ব্যবহার করা যাবে। প্রকল্পটির বিষয়ে জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কিছু টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে কাজ বিলম্বিত হচ্ছে। আমরা এখন এই প্রকল্পের সবকিছু নতুন করে তৈরি করছি। আশা করছি, শিগগিরই ডিপিপি অনুমোদিত হবে। এই প্রকল্পে যে অর্থ ব্যয় হবে এর ৯০ শতাংশই যাবে জমি অধিগ্রহণে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটির জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রথমে একটি স্টাডি রিপোর্ট তৈরি করে ঢাকার জেলা প্রশাসককে (ডিসি) দেওয়া হলেও সেটি অনুমোদন দেয়নি ডিসি অফিস। ডিসি অফিস থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হয়, আরএস ম্যাপের মাধ্যমে স্টাডি না করে সিএস ম্যাপের মাধ্যমে স্টাডি রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। ফলে আগের রিপোর্টটি বাতিল হয়ে যায়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিকল্পনা-১ শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, এখন সিএস ম্যাপ অনুসরণ করে নতুন করে স্টাডি করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা চলতি মাসের মাঝামাঝি অনুমোদন দিয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ওই কর্মকর্তা জানান, এখন দ্রুত নিয়োগ দেওয়া হবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। চার মাসের মধ্যে স্টাডি রিপোর্ট তৈরি করে ডিসি অফিসে দেওয়া হবে। এরপর জমি অধিগ্রহণে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে সে বিষয়ে ডিসি অফিস থেকে জানানো হলে ডিপিপি তৈরি করে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সবকিছু যথাসময়ে সম্পন্ন হলে আগামী বছর ইস্টার্ন বাইপাস প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। সূত্র জানায়, ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় রাজধানী ঢাকার চারপাশ তলিয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় মোহাম্মদপুর, মিরপুর, বাড্ডা, উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন নিচু এলাকায় বন্যার পানি ঢুকে পড়েছিল। নগরবাসীর একটা অংশ পানিবন্দী ছিলেন দীর্ঘদিন। এর পরই রাজধানী ঢাকাকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করতে ১৯৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ইস্টার্ন বাইপাস নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়। কিন্তু প্রায় প্রতিবছর বন্যা রাজধানীবাসীকে হুঙ্কার দিলেও বাইপাস নির্মাণের কাজ আজও শুরু হয়নি। নগরবাসী বলছেন, ইস্টার্ন বাইপাস বাস্তবায়িত হলে বন্যার যে শঙ্কা প্রতিবছর দেখা দেয়, সেই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। তাই দীর্ঘসূত্রতা দূর করে দ্রুত এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা জরুরি।

পাউবো সূত্র জানায়, ইস্টার্ন বাইপাস মূলত টঙ্গী খাল থেকে শুরু হয়ে তুরাগ নদের পাশ দিয়ে তেরোমুখ ব্রিজ হয়ে বালু নদী, পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে অতিক্রম করে বালু নদীর পাশ দিয়ে মাদানী এভিনিউয়ে মিলিত হবে।

এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বন্যার হাত থেকে ঢাকা শহরকে রক্ষা করার পাশাপাশি রাজধানীর যানজট কমাতেও ভূমিকা রাখবে। যানবাহনগুলো ঢাকার ভিতর প্রবেশ না করেই বাইপাস দিয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যেতে পারবে।

সূত্র জানায়, ১৯৯৯ সালে এই প্রকল্পের জন্য নতুন ডিপিপিতে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকাই ব্যয় হবে প্রকল্প এলাকার জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন খাতে। এখন নতুন করে আবার ডিপিপি করা হবে, যেখানে ব্যয় আরও বাড়বে বলে জানা গেছে।

অথচ ১৯৯৯ সালে যখন এ প্রকল্পের প্রথম পরিকল্পনা করা হয়, তখন সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের তহবিল (জিওবি) থেকে ১ হাজার ৯৩ কোটি এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ১ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা জোগানের পরিকল্পনা করা হয় সে সময়। প্রথম দিকে বিশ্বব্যাংক এতে অর্থায়নের আগ্রহ দেখালেও পরে সংস্থাটি এ থেকে সরে দাঁড়ায়। পরবর্তী সময়ে জাইকা এতে অর্থায়নের আগ্রহ দেখায়।

প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজও করেছে জাইকা। এটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা, উপকারিতা, উপযোগিতার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামনে একটি প্রেজেন্টেশনও দেয় সংস্থাটি। কিন্তু আমলাতান্ত্রিকতা আর অর্থায়নের শর্ত জটিলতার কারণে সে আলোচনাও ভেস্তে যায়। ফলে অর্থায়নকারী সংস্থা চূড়ান্ত না হওয়ায় ২০ বছর পার হলেও এখনো প্রকল্পটির কাজ শুরু করা যায়নি।

জানা যায়, ২০১৬ সালের শুরুতে জাইকার ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে প্রকল্পটি সম্পর্কে একটি প্রেজেন্টেশন দিয়েছিলেন। এরপর আর কোনো কাজ এগোয়নি। ২০১৮ সালের শেষ দিকে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান সরকার এ প্রকল্পটি নিয়ে আবারও কাজ শুরু করে। গত এক বছরে প্রধানমন্ত্রীর সামনে নতুন করে প্রেজেন্টেশন দেয় পাউবো। অর্থায়নকারী বৈদেশিক সংস্থা আগ্রহ না দেখানোয় সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। এ জন্যই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী নতুন করে ডিপিপিও তৈরি করেছে পাউবো।

জানা যায়, প্রকল্পটি ১৯৯৯ সালের ৩ ডিসেম্বর একনেকে অনুমোদনের পর কেটে গেছে প্রায় ২০ বছর। রুট নির্দিষ্ট করা হলেও নকশা এখনো চূড়ান্ত করা যায়নি প্রকল্পটির। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শিগগিরই এর নকশা চূড়ান্ত হবে।

পাউবো সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও রাজধানীর অভ্যন্তরে যানবাহনের চাপ কমাতে ঢাকার উত্তর দিকে টঙ্গী খাল, দক্ষিণে ঢাকা-ডেমরা রোড, পূর্বে বালু নদী এবং পশ্চিমে প্রগতি সরণি পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার ইস্টার্ন বাইপাস রোড নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৯৯ সালের ৩ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে প্রকল্পের ধারণাপত্র (পিসিপি) অনুমোদিত হয়।

অপর একটি সূত্র জানায়, ‘ঢাকা সমন্বিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ-কাম-ইস্টার্ন বাইপাস সড়ক বহুমুখী প্রকল্প’-এর জন্য যৌথভাবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০০০ সালে কিছু কাজ করে। এ দুই প্রকল্পের জন্য সে সময় ৭০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করে সরকারি এ সংস্থাটি। এর অংশ হিসেবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর কর্তৃক টঙ্গী থেকে শাহ আলী মাজার পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ পাকা করা হয়। পাশাপাশি তুরাগ নদের তীর ঘেঁষে নির্মাণ করা হয় কয়েক কিলোমিটার ওয়াকওয়ে। কিন্তু অর্থ সংকটের কারণে ২০০৩ সালে কাজ স্থগিত হয়ে যায়।

পাউবোর তথ্যমতে, ইস্টার্ন বাইপাস সড়কটি উত্তর দিকে টঙ্গী খাল, দক্ষিণে ঢাকা-ডেমরা রোড, পূর্বে বালু নদী এবং পশ্চিমে প্রগতি সরণি দিয়ে পরিবেষ্টিত হওয়ার কথা রয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকার ভিতরে যানজট অনেকটাই কমে যাবে। কেননা, এ বাইপাস ব্যবহার করে গাড়িগুলো ঢাকার ভিতরে প্রবেশ না করেও রাজধানীর এক পাশ থেকে অন্য পাশে চলাচল করতে পারবে।

সর্বশেষ খবর