সোমবার, ২৭ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

এনসিসির এমডিকে আবারও চুক্তিতে নেওয়ার পাঁয়তারা

নিজস্ব প্রতিবেদক

মানি লন্ডারিং, অনিয়ম জালিয়াতি করেও প্রায় তিন বছর বহাল রয়েছেন এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। অবৈধ ব্যাংকিং, অর্থ পাচার, কর ফাঁকির অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে অপসারণ করার উদ্যোগ নিলেও তা আদালতে রিট করে ঠেকিয়ে রেখেছেন। এখন আবারও এই এমডি নিজের মেয়াদ বৃদ্ধির তোড়জোড় শুরু করেছেন। দুই প্রভাবশালী ব্যক্তির আশীর্বাদে এনসিসি ব্যাংকের শীর্ষ পদ ধরে রেখেছেন তিনি। এনসিসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেও প্রভাব বিস্তার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন পাঠিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি থেকে তার আবেদন নাকচ করা হলেও আবারও রিভিউর জন্য পাঠিয়েছেন। একই সঙ্গে তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছেন। এনসিসি ব্যাংকের একাধিক গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকটিকে একজন এমডি ডুবাচ্ছেন। তারা বলছেন, একটি ব্যাংকের এমডিকে অবশ্যই ব্যবসায়ীবান্ধব হতে হয়। কিন্তু এনসিসি ব্যাংকের বর্তমান এমডি ব্যবসায়ীদের উল্টো হয়রানি করেন।

জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর এনসিসি ব্যাংকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) পদে যোগ দেন মোসলেহ উদ্দিন। ২০১৭ সালের আগস্টের শুরুতে তিনি এমডির দায়িত্ব পান। এই দায়িত্ব পেয়েই নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে তিনি নানা সুবিধা গ্রহণ করেন। সুবিধা নেওয়া ছাড়া কোনো ঋণ প্রস্তাব তার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। করোনাকালীন এই দুর্যোগের সময় ব্যাংকের ব্যবসায়ী গ্রাহকদের সুবিধা না দিয়ে নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের সুবিধা দিয়েছেন। সরকারের প্রণোদনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভালো ব্যবসায়ীদের কোনোভাবেই সুবিধা দেননি। বরং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আরও হয়রানি করেছেন। প্রণোদনা বাস্তবায়নের গড়িমসি করায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে একাধিক ব্যবসায়ী অভিযোগও করেছেন।

গত বছরের এপ্রিলে এনসিসি ব্যাংকের এমডি মোসলেহ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলন, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও কর ফাঁকি এবং মানি লন্ডারিংয়ের সুনির্দিষ্ট তথ্য উদঘাটন করে দেশের কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউ। বিএফআইইউর তদন্তে মোসলেহ উদ্দিন আহমেদের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের প্রায় ৩৫ কোটি টাকা থাকার হদিস পায়। ব্যাংকের ঋণগ্রহীতার টাকা ছাড়াও পরামর্শক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং শেয়ারবাজার থেকেও তাঁর হিসাবে টাকা জমা হয়েছে। সংস্থাটির বিশেষ অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে আসে। মূলত বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্রোকারেজ হাউসে এমডির নিজের ও স্ত্রীর নামে এই অর্থের লেনদেন হয়েছে। পাঁচটি ব্যাংকে থাকা মোসলেহ উদ্দিনের হিসাব জব্দ করে বিএফআইইউ। ব্যাংকগুলো হলো- এনসিসি, যমুনা, প্রাইম, সিটি ও প্রিমিয়ার। একই সঙ্গে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের হিসাবও জব্দ করেছে সংস্থাটি। বিশেষ অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বিএফআইইউ পক্ষ থেকে বলা হয়, ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে থাকা অবস্থায় তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও কর ফাঁকির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছেন। অনুসন্ধান চালিয়ে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও শেয়ারবাজারে মোসলেহ উদ্দিন ও তাঁর স্ত্রীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ১৪টি ব্যাংক হিসাব, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ছয়টি মেয়াদি আমানত, সীমাতিরিক্ত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ এবং শেয়ারবাজারে চারটি বিও হিসাব পরিচালিত হওয়ার তথ্য পায় বিএফআইইউ। এতে মোট ৩৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য উদঘাটিত হয়। বিএফআইইউর পর্যালোচনায় বলা হয়, মোসলেহ উদ্দিন কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় নৈতিকস্খলন, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও কর ফাঁকির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছেন, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ। ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও শেয়ারবাজারে হিসাব খোলার সময় তিনি অর্থের উৎস সম্পর্কে অসত্য তথ্য দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা ও বিনিয়োগ করেছেন, যা পুরোপুরি মানি লন্ডারিং। সঞ্চয়পত্র ক্রয় বিধিমালার সর্বোচ্চ সীমা একের পর এক লঙ্ঘন করেছেন। নিজ নামে ও স্ত্রীর নামে সাড়ে ছয় কোটি টাকার অধিক সঞ্চয়পত্র ক্রয় ও মুনাফা উত্তোলন করেছেন। এ ছাড়া মোসলেহ উদ্দিন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) ২০১৮ সালে দাখিলকৃত আয়কর বিবরণীতে তাঁর ১৮টি হিসাবের তথ্য গোপন করে মোটা অঙ্কের রাজস্ব থেকে সরকারকে বঞ্চিত করেছেন, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২(শ) ধারা মোতাবেক করসংক্রান্ত অপরাধ।

এরপর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিএফআইইউ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশনে চিঠি দেওয়া হয়। এই চিঠির পর দুই সংস্থা থেকেই তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। তদন্ত চলাকালে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তিনি ক্ষমতাবান একজন ব্যবসায়ী নেতা ও একজন রাজনৈতিক নেতার মাধ্যমে তা ঠেকিয়ে দেন। এতে তাকে সাময়িক অব্যাহতিও দেওয়া হয়নি। ফলে ব্যাপক দুর্নীতি করেও গত ১৫ মাসের বেশি সময় স্ব-পদে বহাল থেকে নজির স্থাপন করেছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে সখ্য আছে মোসলেহ উদ্দিনের। এ ছাড়া এনসিসি ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যানের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক রয়েছে। ফলে তদন্ত কাজে কালক্ষেপণ এবং ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব হচ্ছে।

জানা যায়, বিএফআইইউর পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন পাওয়ার পর মোসলেহ উদ্দিনের অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে তাঁর কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে ব্যাখ্যা তলব করা হয়। তিনি যে ব্যাখ্যা দেন তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে অপসারণ নিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠন করা হয়। এরপর কয়েক দফা ব্যাখ্যা তলবের পাশাপাশি এনসিসির এমডিকে শুনানির জন্য ডাকা হয়। কয়েক মাস আগে কমিটি তাদের সুপারিশ গভর্নরের কাছে দাখিল করেছে। ওই সুপারিশের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। স্ট্যান্ডিং কমিটিতে শুনানি চলাকালেই পদ রক্ষার জন্য তিনি আদালতে রিট করে অপসারণ প্রক্রিয়া আটকে দেন। আদালতে রিটে তিনি উল্লেখ করেন, যেহেতু তিনি বিএফআইইউর প্রতিবেদন পাননি, সে জন্য স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে চাহিদামতো জবাব দিতে পারছেন না। আবার ওই রিটের আদেশে আদালতও বিএফআইইউকে কোনো প্রতবেদন দেওয়ার কথা বলেনি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আবু ফরাহ মো. নাছের বলেন, এ মাসেই এনসিসি ব্যাংকের এমডির পুনঃনিয়োগের বিষয়ে আবেদন আসে। কিন্তু আমরা সেটি নাকচ করে দিয়েছি। মোসলেহ উদ্দিনের পুনঃনিয়োগের আবেদন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নাকচের কথা স্বীকার করে এনসিসি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, আবেদন পুনঃবিবেচনার জন্য এখন তিনি রিভিউ করার চেষ্টা করছেন।

সর্বশেষ খবর