বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

টেকনাফে জিরো টলারেন্স

মাদকের বিরুদ্ধে চলছে অভিযান, গোলাগুলিতে আরও পাঁচজন নিহত এক মাসে নিহত ৫৭ অভিযান চলবে

সাখাওয়াত কাওসার ও আয়ুবুল ইসলাম

মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে সরকার। চলমান মহামারীতেও মাদক চোরাকারবারিদের তৎপরতা অব্যাহত থাকায় ভাবিয়ে তুলছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের। তবে শিগগিরই সবগুলো সংস্থা সমন্বিতভাবে মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করবে। তবে এরই মধ্যে ২০ জুলাই পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণের পর থেকে নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ ও র‌্যাব। গতকাল কেবল কক্সবাজারেই পুলিশ মাদক-সংশ্লিষ্ট পাঁচটি লাশ উদ্ধার করেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, চলতি জুলাই মাসের ২৮ তারিখ পর্যন্ত সারা দেশে ৪৩ জন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু কক্সবাজারেই বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ২৩ জন।

র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘র‌্যাব বরাবরই মাদক নিয়ে সিরিয়াস। সৃষ্টির পর থেকেই মাদক নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে এই এলিট ফোর্স। তবে বর্তমানে আইজিপি স্যারের বিশেষ নির্দেশনার পর নতুন করে আবারও র‌্যাবের সব অধিনায়ককে মাদকের বিষয়ে বিশেষ অভিযানের কথা বলা হয়েছে।’ জানা গেছে, মাদকবিরোধী অভিযানে গড়িমসি করলেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে পুলিশ, র‌্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তরফ থেকে। ১৫ দিন ধরে প্রতি সপ্তাহের অর্জনের বিষয়ে স্বয়ং আইজিপি কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট রেঞ্জ, ইউনিটপ্রধান এবং জেলার পুলিশ সুপারদের সঙ্গে। সূত্র বলছে, চলমান করোনা মহামারীতেও মাদকের চাহিদা কমেনি। বিভিন্ন পন্থায় এবং রুট পরিবর্তন করে দেশের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে। পরিবহনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স, পণ্য পরিবহনের গাড়ি, কুরিয়ার সার্ভিস। মাঝে মধ্যেই মাদকের চালানসহ বাহকরা ধরা পড়লেও গডফাদাররা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। আড়ালে থেকেই কলকাঠি নাড়ছে প্রতিনিয়ত। দুর্নীতিবাজ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ম্যানেজ করে মাদকের বড় বড় চালান তারা পৌঁছে দিচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মাদক নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন। স্বল্পমেয়াদি কোনো ধরনের অপারেশন সাময়িক স্বস্তি আনলেও কিছুদিন পর তা আবার আগের মতো হয়ে যাওয়ার বহু উদাহরণ রয়েছে। তিনি বলেন, মাদক একটি আন্তমহাদেশীয় অপরাধ। চাহিদা থাকলে এর সরবরাহ বন্ধ করা মুশকিল। সীমান্ত অরক্ষিত রেখে সারা দেশে অভিযান চালালে খুব একটা লাভ আসবে না। মাদক নির্মূলে সমন্বিত এবং দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগের প্রয়োজন। গডফাদার না ধরে চুনোপুঁটি ধরলে মাদক কখনো নিয়ন্ত্রণে আসবে না। এ জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকেও ঢেলে সাজাতে হবে। আইনকে আরও যুগোপযোগী এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। একাধিক সূত্র অনুযায়ী, কারাবন্দী কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী এখনো মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের মধ্যে সানজিদুল ইসলাম ইমনের সহযোগীদের বিষয়টি ইতিমধ্যে আঁচ করতে পেরেছেন বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা। সম্প্রতি ইমনের সাতজন সহযোগী কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার সাহপাড়া এলাকার বাবু খন্দকারের বাড়িতে অবস্থান করে মাদকের চালান নিতে ট্রলারে করে মেঘনা নদীতে যায়। সেখানে রহস্যজনকভাবে ট্রলার ডুবে গেলে সজীব ও তানভীর হোসেন অনিক নিখোঁজ হয়। সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হয় মাঝিসহ ছয়জন। এদিকে ২১ জুলাই রাতে ঢাকার দক্ষিণখান থানার আশিয়ান সিটি এলাকায় র‌্যাব-১-এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে রিপন নামে এক অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ওয়ান শুটারগান, গুলি ও প্রায় ২ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে। ১৯ জুলাই রাতে ঢাকার খিলগাঁও থানার পশ্চিম নাগদারপাড় এলাকায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মো. রাজীব নামে এক মাদক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, দুই রাউন্ড গুলি ও ৫০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে। ডিবি বলছে, রামপুরা ও খিলগাঁও এলাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন রাজীব। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মাদক ও অস্ত্র আইনে ২৫টি মামলা রয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। মাদকের সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে তিনি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন। মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান তীব্র করার নির্দেশনা জারি করেছেন। অভিযানের ক্ষেত্রে গড়িমসি করার সঙ্গে জড়িতদের হুঁশিয়ার করেছেন পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (গোয়েন্দা ও অপারেশনস) পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এস এম মাসুম রাব্বানী বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যেও দেশে মাদক ঢুকছে। আর ঈদকে কাজে লাগিয়ে মাদক কারবারিরা কোরবানির পশুবাহী ও পণ্যবাহী যানবাহনে নতুন নতুন কৌশলে মাদক আনার পরিকল্পনা করছে বলে তাদের কাছে গোয়েন্দাতথ্য আছে। এ জন্য দেশের যেসব জায়গা থেকে অধিক হারে কোরবানির পশু আসে, সেখানে সোর্স নিয়োগের পাশাপাশি তাদের নিজস্ব গোয়েন্দাদের কাজে লাগানো হচ্ছে।

একাধিক সূত্র বলছে, রাজধানীর বস্তির মাদক নিয়ন্ত্রণ করছে বস্তি নিয়ন্ত্রণকারীদের একটি বড় অংশ। আর বিহারি ক্যাম্পে মাদক নিয়ন্ত্রণ করছে বহুল আলোচিত ইশতিয়াক। সে বোতল কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করে বর্তমানে মাদক ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। এখন আর সে ক্যাম্পে বসবাস করে না। তার নেতৃত্বে ঢাকার সব বিহারি ক্যাম্পে চলছে মাদকের কারবার। সবচেয়ে বেশি মাদক, বিশেষ করে ইয়াবার রমরমা বাণিজ্য এখন মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পগুলোতে। গাঁজা শাকিলের নেতৃত্বে পারভেজ এবং মৃত বিহারি জিয়ার ছেলে পাগলা মনু মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পে ইয়াবা ব্যবসার সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের সঙ্গে রয়েছে নারী সিন্ডিকেট। মোবাইল ফোনের হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ম্যাসেঞ্জার ও ইমোতে কথা বলার পর ইয়াবা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এদের নানাভাবে সহায়তা করার অভিযোগ উঠেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক পদের একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

কক্সবাজারে পাঁচ মাদক ব্যবসায়ীর লাশ : কক্সবাজারের টেকনাফের হোয়াইক্যং এলাকায় মাদক কারবারিদের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে চারজন মাদক কারবারি নিহত হয়েছে। এ ছাড়া শহরের সমুদ্রসৈকত-সংলগ্ন কবিতা চত্বর এলাকা থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, গতকাল ভোররাত ৪টার দিকে টেকনাফ হোয়াইক্যংয়ের পশ্চিম সাতঘড়িয়াপাড়া এলাকায় দুই দল মাদক কারবারির মধ্যে ইয়াবার লেনদেন নিয়ে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এমন খবরে টেকনাফ থানার একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। মাদক কারবারিরা উপস্থিতি টের পেয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। পুলিশও নিজেদের আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। একপর্যায়ে গোলাগুলি থেমে গেলে ঘটনাস্থল থেকে দুটি দেশে তৈরি এলজি, আট রাউন্ড গুলি ও ৫০ হাজার ইয়াবাসহ চার গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরে গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের টেকনাফ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক চারজনকেই মৃত ঘোষণা করেন।

নিহত মাদক কারবারিরা হলো হোয়াইক্যং ইউনিয়নের খারাংখালীর বাসিন্দা নাছির (২৩), টেকনাফ সদর ইউনিয়নের পূর্ব মহেশখালিয়াপাড়ার বাসিন্দা আনোয়ার (২৪), হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পশ্চিম সাতঘড়িয়াপাড়ার বাসিন্দা ইসমাইল (২৫), হোয়াইক্যং ইউনিয়নের আমতলীর বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন (২২)।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর