বুধবার, ৫ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ফরিদপুর আওয়ামী লীগে

আটক তালিকায় অর্ধশতাধিক নেতা, তদন্ত ২ হাজার কোটি টাকা পাচার নিয়ে

কামরুজ্জামান সোহেল, ফরিদপুর

দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ফরিদপুর আওয়ামী লীগে

ফরিদপুর আওয়ামী লীগে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলছে। এতে একের পর এক রুই-কাতলা ধরা পড়ছে। সর্বশেষ ঈদের আগের দিন পুলিশের অভিযানে আটক হয় শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি খন্দকার নাজমুল হাসান লেভী, জেলা শ্রমিক লীগের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক বিল্লাল হোসেন ও শহর যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসিবুর রহমান ফারহান।

এর আগে আটক হন সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এমপির বিশ্বস্ত, শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও তার ভাই ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের বহিষ্কৃত সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেল, পৌর কাউন্সিলর মামুনুর রহমান, ডিক্রিরচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন আবুসহ কয়েক নেতা। আটক তালিকায় আছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের বেশকিছু প্রভাবশালী নেতাসহ জনপ্রতিনিধি, চাকরিজীবী, সাংবাদিকসহ কমপক্ষে অর্ধ শতাধিক ব্যক্তি। দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী ফরিদপুরের আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতারের খবরটি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রিতে’ পরিণত হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী এ অভিযানকে ফরিদপুরবাসী স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি তারা কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। বিগত ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই দুর্যোগ নেমে আসে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগে। দলটির প্রবীণ ও ত্যাগী নেতারা নানা কারণে দলের কর্মকান্ড থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন। দলে অনুপ্রবেশ ঘটে বিএনপি-জামায়াত থেকে আসা কতিপয় সুযোগ সন্ধানী। এসব হাইব্রিডের দাপটে কোণঠাসা হয়ে পড়েন একসময়ের তুখোড় নেতারা। যারা ফরিদপুরে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে জীবনের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছেন, তাদের নিগৃহীত হতে হয়। করা হয় অপমান, লাঞ্ছিত। দলের প্রবীণ-নবীন কয়েক নেতাকে কুপিয়ে আহত করা হয়। ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে ভুলপথে রেখে একটি চক্র রাজনীতির নোংরা খেলায় মেতে ওঠে। এ চক্রটির হাতে ক্ষমতা থাকায় তারা দিনকে রাত আর রাতকে দিন করতে থাকেন। এহেন কোনো অপকর্ম নেই যা এই চক্রটি করেনি। কথিত আছে, বিগত ১০ বছরে ফরিদপুরে বিএনপির নেতারা যতটা নির্যাতনের শিকার না হয়েছেন, তার চেয়ে বেশি নির্যাতন, হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতারা। ‘হাতুড়ি বাহিনী, ‘হেলমেট বাহিনী’ গঠন করে দলের ত্যাগী ও সরব নেতাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে দলীয় কর্মকান্ড থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। প্রবীণ নেতাদের প্রতি পদে পদে লাঞ্ছিত আর অপমান করা হয়। আওয়ামী লীগ আমলেই অনেক নেতাকে সরিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন থেকে। সেখানে বসানো হয় এমপিপন্থিদের। অপমান এবং লাঞ্ছিত হয়ে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় চলে যেতে বাধ্য হন কেউ কেউ। অনেকেই আবার রাজনীতি থেকে নীরবে বিদায় নেন। বিগত কয়েক বছর ধরে ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের হর্তা-কর্তা হিসেবে পরিচিত ত্রিরত্ন (ফুয়াদ-বরকত-রুবেল) ‘এফ বি আর’ দলের পুরনো নেতাদের হটিয়ে তাদের অনুসারীদের দলে অনুপ্রবেশ করান। শহরে যারা নানাভাবে বিতর্কিত সেইসব ব্যক্তিদের নিয়ে রাজনীতি শুরু করেন আলোচিত সেই ‘ত্রিরত্ন’। ফলে ক্রমেই সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হতে থাকে আওয়ামী লীগ। গোপনে বিএনপির একাংশ এবং জামায়াতের সঙ্গে সখ্য রেখে সদর আসনের এমপির কাছে নিজেদের বড় নেতা জাহির করতে নানা পরিকল্পনা করেন। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ‘টাকা ছড়িয়ে’ বিভিন্ন স্থান থেকে বাস-ট্রাক ভাড়া করে লোক এনে শো-ডাউন করতে থাকেন। বছরের বেশির ভাগ দিনই চলতে থাকে এমন শো-ডাউন। এরই মাঝে ফরিদপুরের বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি দফতর থেকে টেন্ডারবাণিজ্য, বদলিবাণিজ্য, কমিশনবাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। জিম্মি করে রাখা হয় ফরিদপুরের বেশিরভাগ দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। বাধ্যতামূলকভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে হতো সরকারি-বেসরকারি দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকেই দলীয় মনোনয়ন দিতে দেওয়া হয়নি। টাকার বিনিময়ে এবং যারা ‘ত্রিরত্ন’দের বিপক্ষে ছিলেন তাদের বাদ দিয়ে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে আসা ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। বিগত দিনে যারা আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত হিসেবে পরিচিত ছিলেন তাদের হটিয়ে দেওয়া হয়েছে সবখান থেকে। ফরিদপুর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতার দাপট দেখানো হয়। আওয়ামী লীগের জাদরেল নেতা শামসুল হক ভোলা মাস্টারের মনোনয়নটি অবৈধ ঘোষণা করা হয় প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে। খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণেই তার মনোনয়নটি অবৈধ ঘোষণা করে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করা হয় তাদের মনোনীত প্রার্থীকে। ফরিদপুর জেলা ও উপজেলার রাজনীতি পরিচালিত হতো ‘আফসানা মঞ্জিল’ থেকে। এটি ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বাসভবন হিসেবে পরিচিত। জেলা ও উপজেলার সব বিষয়ে ফরিদপুর থেকে নাক গলানোর কারণে অন্য আসনের এমপিদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয় খন্দকার মোশাররফ হোসেনের। এর জন্য আওয়ামী লীগের অনেকেই দায়ী করেন ‘ত্রিরত্ন’ হিসেবে পরিচিত ‘ফুয়াদ-বরকত-রুবেল’ অর্থাৎ ‘এফবিআর’-কে। ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন নিয়েও নানা সমালোচনার সৃষ্টি করা হয়। নিজেদের কর্তৃত্ব ঠিক রাখতে এবং দলের ‘সরব’ নেতাদের বাদ দিয়ে কমিটিতে স্থান দেওয়া হয় তাদের অনুসারীদের। বাদ পড়েন অনেক ত্যাগী ও পরীক্ষিত প্রবীণ নেতা। শুধু জেলা আওয়ামী লীগই নয়, দলের সহযোগী সংগঠনগুলোকেও একই কায়দায় কমিটি করে ত্যাগীদের বঞ্চিত রাখা হয়। আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ ক্ষোভে ফুঁসে উঠলে তাদের ওপর নানা কায়দায় নিপীড়ন চালানো হয়। সেই সব নেতাদের মনে দুঃখ থাকলেও তারা আর প্রতিবাদ করেনি। দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদকে ‘মাইনাস’ করে তাকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। এমনিভাবে দলের একাধিক নেতাকে ‘মাইনাস’ করে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে ত্যাগী নেতাদের ওপর স্টিমরোলার ও নীরবে নির্যাতন চালানোর কারণে অনেকেই রাজনীতি থেকে দূরে সরে ছিলেন। রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও তারা ‘হাইব্রিডদের’ বিরুদ্ধে সরব ছিলেন সব সময়। দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তারা একাধিকবার এ বিষয়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরেন। তারা আশায় ছিলেন একদিন এই ‘কালো অধ্যায়ের পতন’ হবে। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে অবশেষে ফাঁদে ধরা পড়েন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা দুই ভাই সাজ্জাদ হোসেন বরকত আর ইমতিয়াজ হাসান রুবেল। ১৬ মে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল সাহার বাড়িতে পরিকল্পিতভাবে দুই দফায় হামলা চালানো হয়। সেই ঘটনায় ১৮ মে সুবল সাহা অজ্ঞাতদের আসামি করে থানায় মামলা করেন। ৭ জুন এ মামলার আসামি হিসেবে শহরের বদরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ আটক করে বরকত-রুবেলসহ নয়জনকে। বরকত-রুবেল গ্রেফতার হওয়ায় আওয়ামী লীগের একাংশের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। পরদিন সকালে দলের বড় একটি অংশ শহরে আনন্দ মিছিল বের করে। বিতরণ করা হয় মিষ্টিও। বরকত-রুবেল আটকের পর গাঢাকা দেয় বিতর্কিত কয়েকশ নেতা-কর্মী। এখন তারা ফরিদপুর ছাড়া এবং পলাতক রয়েছে। ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের জাদরেল নেতাদের আটক সম্পর্কে পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান জানান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলার ঘটনায় আটক করা হয় সাজ্জাদ হোসেন বরকত, ইমতিয়াজ হাসান রুবেলসহ কয়েকজনকে। পরবর্তীতে দুই হাজার কোটি টাকা মানি লন্ডারিং মামলা করে সিআইডি। সেই মামলায় বরকত-রুবেলের স্বীকারোক্তিতে অনেকের নাম এসেছে। সিআইডির চাহিদা মোতাবেক তালিকা অনুযায়ী তাদের আটক করা হচ্ছে। আটকের তালিকায় আরও অনেকেই রয়েছেন। তাদের আটকের চেষ্টা চলছে।

সর্বশেষ খবর