শুক্রবার, ৭ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

দেশে ফিরতে মরিয়া লেবানন প্রবাসীরা

এখনো নিখোঁজ তিন বাংলাদেশিসহ ৩৭ জন, লেবাননে জরুরি খাদ্য ও মেডিকেল টিম পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ

শিমুল মাহমুদ

দেশে ফিরতে মরিয়া লেবানন প্রবাসীরা

বৈরুতে ধ্বংসস্তূপে কাজ শুরু করেছেন কর্মীরা -এএফপি

প্রায় এক বছর ধরেই লেবাননে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। কাজ ও বেতনহীন অনেক প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরে আসতে মরিয়া। জুলাই পর্যন্ত বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাসে নাম নিবন্ধন করে দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন সাড়ে ৭ হাজার প্রবাসী। গত মঙ্গলবারের ভয়াবহ বিস্ফোরণে বিপর্যস্ত লেবানন থেকে এখন পারলে সব প্রবাসীই দেশে ফিরতে চান। বিস্ফোরণের তৃতীয় দিনেও গতকাল পর্যন্ত ১৩৭ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে স্থানীয় প্রশাসন। নিখোঁজ রয়েছেন তিন বাংলাদেশিসহ ৩৭ জন। ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার কার্যক্রম গতকালও অব্যাহত ছিল। চার বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যুর পাশাপাশি শতাধিক প্রবাসী শ্রমিক আহত হয়েছেন। বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাস প্রবাসীদের সর্বক্ষণ খেঁাঁজ রাখছে। প্রবাসী শ্রমিক ইয়াসিন ভূইয়া বলেন, ‘আমার মাথা ফেটে গেছে। গ্লাস ভেঙে পড়ায় হাত কেটেছে, পা কেটেছে। তাই এত আঘাত পেয়েছি। হসপিটালে গিয়েছিলাম, কিন্তুু ডাক্তার দেখাতে পারিনি। সবাই দোয়া করবেন আল্লাহ যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দেন।’ তার মতো অনেকেই বিনা চিকিৎসায় ধুঁকছেন। গতকাল লেবানন প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক এবং অন্য পেশাজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে হাজার হাজার শ্রমিকের কাজ নেই, বেতন নেই। প্রায় ৪০ লাখ মানুষের দেশটিতে সর্বাধিক দেড় লাখ বাংলাদেশি কাজ করছেন। তার অধিকাংশই গৃহকর্মী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী। আর্থিক দুরবস্থার কারণে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা গত কয়েক মাসে একাধিকবার বড় বিক্ষোভ করেছেন। মানুষের হাতে টাকা নেই। বাজারে সবকিছুর দাম চড়া। এক বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়ে গেছে ছয় গুণ। ২০১৯ সালের মে-জুনে ১ হাজার ৫০০ লেবানিজ লিরায় ১ ডলার পাওয়া যেত। এখন ১ ডলার বিনিময় হচ্ছে ৯ হাজার লিরায়। এ পরিস্থিতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা সীমাহীন কষ্টে আছেন। আগের বেতন দিয়ে তারা খেয়েপরে টিকতে পারছেন না। অনেকে মাসের পর মাস দেশ থেকে টাকা নিয়ে জীবন বাঁচাচ্ছেন। এজন্য দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। অবশ্য বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাস এই দুঃসময়ে লেবানন প্রবাসী শ্রমিকদের সহায়তার চেষ্টা করছে। ৪ আগস্ট বৈরুত পোর্টে বিস্ফোরণের দুই দিন আগেই ২ আগস্ট লেবাননের ডিটেনশন সেন্টার থেকে ৬৪ বাংলাদেশিকে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে দেশে পাঠিয়েছে দূতাবাস। দূতাবাসের ফেসবুক পেজে এ সম্পর্কিত একটি ঘোষণার নিচে ৫২৮ জন প্রবাসী নিজেদের দুর্ভোগের কথা উল্লেখ করে দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন। মঙ্গলবার বৈরুত বন্দর এলাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর বুধবার সংঘটিত ঘটনার বিষয়ে লেবাননে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আল মুস্তাহিদুর রহমান একটি ভিডিওবার্তা দেন। সেটি কয়েক ঘণ্টায় ৯৭০ জন প্রবাসী শেয়ার করেন। তাতে কমেন্ট করেন ১৪৪ জন প্রবাসী। তার প্রায় সবাই দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন। সেখানে মো. আলমগীর বলেছেন, ‘বাংলাদেশ দূতাবাস এবং বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমরা লেবানন প্রবাসীদের আকুল আবেদন- আমাদের তাড়াতাড়ি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যান।’ সালেহ উদ্দিন বলেছেন, ‘লেবানন থেকে দ্রুত সব বাংলাদেশি কর্মী ফেরত আনার দাবি জানাচ্ছি। এখনই না আনলে পরবর্তীতে আরও সমস্যা হতে পারে।’ মো. মিজান মিয়া বলেছেন, ‘স্যার! আমি অনেক কষ্টে আছি সাত-আট মাস যাবৎ। এত দিন দেশ থেকে টাকা এনে চলেছি। এখন আর কোনো উপায় দেখতেছি না। দয়া করে আমাকে একটু তাড়াতাড়ি দেশে পাঠানোর চেষ্টা করুন, প্লিজ।’ আতিকুর রহমান শুভ বলেছেন, ‘স্যার! দয়া করে জীবনটা নিয়ে দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।’ সানজিদা আক্তার বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে সাপারার কর্মকর্তারা সবাই সুস্থ আছেন। স্যার! আপনারা আল্লাহর পর শেষ ভরসা, আপনাদের দয়ায় যদি দেশে যেতে পারি।’ ইকবাল হোসেন বলেছেন, ‘স্যার! আর পারতেছি না। দয়া করে একটা ব্যবস্থা করেন প্লিজ।’ মোহাম্মদ রাজু বলেছেন, ‘মরার আগে মা-বাবাকে দেখে যেতে চাই, আমাদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।’ মিলন খান বলেছেন, ‘মহামান্য রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের সব স্যারের প্রতি আকুল আবেদন, স্যার আমাদের বাঁচান, দয়া করে আমাদের তাড়াতাড়ি দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন প্লিজ।’ সাইফুল ইসলাম বলেছেন, ‘স্যার! অতিকষ্টের সঙ্গে বলতে হইতেছে যত দ্রুত দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন মঙ্গল হবে।’ লেবানন প্রবাসী হাজার হাজার শ্রমিক এখন সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে আছেন। আর্থিক দুরবস্থার মধ্যেই তারা বিস্ফোরণের বিপর্যয়ে পড়েছেন। এরই মধ্যে তাদের অনেকের বৈধতার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাই জরিমানা গুনেও দেশে ফিরতে চান তারা। এজন্য প্রতিদিন শত শত লেবানন প্রবাসী শ্রমিক বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তা চাইছেন। তারা বলেছেন, সরকারের উচিত লেবাননের এ বিপর্যয়ের সময়ে বিশেষ ব্যবস্থায় আগ্রহী প্রবাসীদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া।

লেবাননে জরুরি খাদ্য ও মেডিকেল টিম পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ : লেবাননে খাদ্যসামগ্রী, প্রাথমিক চিকিৎসাসামগ্রী এবং মেডিকেল টিম পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। প্রয়োজনে জরুরি ভিত্তিতে লেবাননকে যে কোনো সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আবদুল মোমেন লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছারবেল ওহেবিকে ফোন করে সে দেশে বিস্ফোরণে নিহতদের বিষয়ে সহানুভূতি প্রকাশ করার সময় এসব বিষয় অবহিত করেন। এ সময় ড. মোমেন বিস্ফোরণে আহত বাংলাদেশিদের চিকিৎসাসহ সার্বিক সহযোগিতার জন্য লেবানন সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়ে বলা হয়, লেবাননে শক্তিশালী বিস্ফোরণে চারজন বাংলাদেশি নিহত হন। এতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ২১ সদস্যসহ প্রায় ১০০ জন বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। এ ছাড়া সে দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ ‘বিজয়’- এর ক্ষতি হয়েছে।

সর্বশেষ খবর