শিরোনাম
রবিবার, ৯ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি

খুলেছে সব ধরনের দোকানপাট, স্বাভাবিক হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘুরতে শুরু করেছে শিল্পের চাকা, বাড়ছে উৎপাদন ও রপ্তানি আয় চিন্তা এখন বন্যার ক্ষতি

মানিক মুুনতাসির

চলমান কভিড-১৯ এর প্রভাবে বিপর্যস্ত অর্থনীতি আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। গতি পাচ্ছে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। খুলেছে সব ধরনের দোকানপাট। স্বাভাবিক হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। ঘুরতে শুরু করেছে শিল্পের চাকা। বাড়তে শুরু করেছে উৎপাদন ও রপ্তানি আয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছোট-বড়-মাঝারি সব ধরনের শিল্প-কারখানা আবার চালু হয়েছে। এ ছাড়া মার্চ-এপ্রিল সময়ে বাতিল বা স্থগিত হওয়া রপ্তানি আদেশের ৮০ শতাংশই এরই মধ্যে ফিরে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা মধ্যস্থতা করা হচ্ছে। তবে এরই মধ্যে সারা দেশের প্রায় ৪০টি জেলা বর্তমানে বন্যাকবলিত। এর ফলে কৃষি খাতের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। থেমে গেছে পানিবন্দী মানুষের জীবন-জীবিকা। কভিড-১৯ থেকে ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করার মধ্যেই বন্যার প্রভাবে সারা দেশের অর্থনীতি আবারও ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

কেস স্টাডি-১ : পরিবেশবান্ধব পেপার কাপ উৎপাদনকারী কোম্পানি কেপিসি ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সাজেদুর রহমান। মহামারী শুরু হলে সারা দেশের চা, কফি শপ বন্ধ হয়ে যায়। এতে পেপার কাপের চাহিদাও নেমে যায় তলানিতে। আবার সামনে চলে আসে ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা। ফলে মার্চের পর থেকে জুন পর্যন্ত টানা প্রায় চার মাস তার ফ্যাক্টরিতে উৎপদন বন্ধ ছিল। সে সময় সংকটও ছিল কাঁচামালের। এরপর আবারও ঘুরতে শুরু করেছে শিল্পের চাকা। বিপুল পরিমাণ লোকসানের মুখে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে টিকিয়ে রাখতে ব্যবসার ধরন পাল্টেছেন। পেপার কাপের সঙ্গে ফেস মাস্কের ব্যবসা করেছেন এই চার মাস। তা দিয়েই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছেন। এখন মূল ব্যবসা চালু হলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। কেননা ব্যাংক ঋণ, কাঁচামালের ওপর উচ্চ আমদানি শুল্ক আর চাহিদা কমে যাওয়ায় অ্যাগ্রো-বেইজ কিছু করা যায় কি না তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন কাজী সাজেদুর। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘এই মহামারীতে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা পোষাতে হলে অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে। কেননা মহামারী কবে শেষ হবে তা তো আমরা জানি না। ফলে জীবন ও জীবিকার তাগিদে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি বাঁচাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ব্যবসা-বাণিজ্য এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।’ জানা গেছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব ধরনের শপিং মল ও দোকানপাট খোলায় আবারও শুরু হয়েছে বাণিজ্যিক কর্মকান্ড। তবে আগের অবস্থায় ফিরে যেতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হবে। টানা ছয় মাসের অচলাবস্থায় যারা পুঁজি হারিয়েছেন, তারা আবার নতুন ব্যবসা শুরুর কথা ভাবছেন।

কেস স্টাডি-২ : আনোয়ার আলী। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর। রাজধানীর একটি অভিজাত বিপণিবিতানে চশমার ব্যবসা করেন। প্রতি মাসে দোকান ভাড়া ১৫ হাজার টাকা। কভিড-১৯ এর কারণে তিন মাসের বেশি সময় বন্ধ ছিল সেই শপিং মল। সে সময়টা গ্রামে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে কাটিয়েছেন। এখন প্রায় এক মাস হলো শপিং মল খুলেছে। দোকান চালু করেছেন। তবে গত চার মাসের দোকান ভাড়া বকেয়া পড়েছে, যা কিস্তিতে পরিশোধ করবেন বলে মালিকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বর্তমানে বেচাকেনা কম। তবে তিনি পুনরায় ব্যবসা চালু করতে পেরেছেন এতেই খুশি। আনোয়ার আলী বিশ্বাস করেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে খুব দ্রুতই আবার তার ব্যবসা ভালো হবে। তবে এখন আর বেশি লাভ করার জন্য বসে থাকেন না। কাস্টমার এলে লাভ কম হলে জিনিস ছেড়ে দেন। এতে অন্তত ডাল-ভাত খেয়ে বাঁচতে পারবেন। সঙ্গে ব্যবসাটাও টিকে থাকবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি।

জানা গেছে, আনোয়ার আলী ও কাজী সাজেদুর রহমানের মতো অবস্থা দেশের সব শ্রেণির ব্যবসায়ীর। বৃহৎ শিল্পের মালিকরাও রয়েছেন সংকটে। মহামারীর কারণে স্থগিত হওয়া ব্যাংক ঋণের কিস্তি আবার চালু হয়েছে। সুদের চাকা ঘুরছে। ফলে ঘোরাতে হচ্ছে শিল্পের চাকাও। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বকেয়া রাখার সুযোগ নেই। ফলে বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে গতি ফিরতে শুরু করেছে।

এদিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আকাশপথও খুলে দেওয়া হয়েছে। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে দেশের অভ্যন্তরীণ আকাশ যোগাযোগও বন্ধ করা হয়েছিল। সেটাও সচল করা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবেও চালু হয়েছে আকাশপথের যোগাযোগ। ফলে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমও চালু হয়েছে। ব্যাংকগুলোতে এলসি খোলা শুরু হয়েছে। তবে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির খরা কাটেনি। এ রকম দু-একটি এলসি নিষ্পত্তি হলেও নতুন করে এলসি হচ্ছে অনেক কম। আশা করা হচ্ছে ধীরে ধীরে আবার নতুন নতুন শিল্প স্থাপন শুরু হলে কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলার হারও বাড়বে। জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পর্যটন কেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সবকিছুই খুলতে শুরু করেছে।  অর্থনীতি বাঁচাতে ও পর্যটক বাড়াতে দেশে দেশে সীমান্ত খুলে দেওয়া হচ্ছে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে এ মুহূর্তে পৃথিবীর কোনো দেশ পুরোপুরি লকডাউনে নেই। তবে লকডাউন শিথিলের পর করোনা সংক্রমণের হার বাড়তে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কলম্বিয়া, ভারত আর ইরানের মতো দেশগুলো কিছু অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন আরোপ করছে। করোনার প্রকোপ সামলাতে বাংলাদেশেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে আজ থেকে আবার শুরু হচ্ছে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত। ফলে আবার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চাঙ্গা হয়ে উঠবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগে বোরো মৌসুমে বাম্পার ফলন হওয়ায় দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্য পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত সন্তোষজনক। এমন মহামারীতেও খাদ্য সংকটে পড়েনি বাংলাদেশ। এদিকে করোনা মহামারীর কারণে বিশ্ব অর্থনীতির যে ক্ষতি হবে, এর আর্থিক পরিমাণ হতে পারে ১২ ট্রিলিয়ন ডলার এমনটাই পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বাংলাদেশেও টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটিতে করোনায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। এই ক্ষতি পোষাতে সামনে অনেক দিন লড়তে হবে বরে মনে করেন শিল্প খাত সংশ্লিষ্টরা। এদিকে করোনা মহামারীর শুরুতে রেমিট্যান্স প্রবাহে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি। শুধু তা-ই নয়, প্রবাসীরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন গত দুই মাস। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেকর্ড ছুঁয়েছে, যা বৃহস্পতিবার ৩৬ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। আর সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৮২০ কোটি ৫০ লাখ (১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন) ডলার, টাকার অঙ্কে যা ১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। এদিকে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে রপ্তানিতে ব্যাপক ধস নামে। কিন্তু জুনে রপ্তানি বাড়তে শুরু করেছে। যদিও আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় জুনে আবার রপ্তানি আড়াই শতাংশ কমে গেছে। গত অর্থবছর রপ্তানি ১৭ শতাংশ কমে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলার। নতুন করে রপ্তানি আদেশ আসা শুরু হয়েছে। তবে রপ্তানি কিছুটা বাড়লেও কমে গেছে আমদানি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কভিড-১৯ এর প্রভাবে পুরো অর্থনীতিই বিপর্যস্ত ছিল। এখন অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হয়েছে। প্রত্যেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে সবকিছু স্বাভাবিক হতে এবং অর্থনীতিকে আগের অবস্থানে নিয়ে যেতে আরও সময়ের প্রয়োজন হবে। এর চেয়েও বড় কথা, কভিড-১৯ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এর ফলে অর্থনীতির বিরূপ প্রভাবটাও হবে দীর্ঘ মেয়াদে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর