মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

ভ্যাট-করের জালে বন্দী বিনিয়োগ

মানিক মুনতাসির

ভ্যাট-করের জালে বন্দী বিনিয়োগ

আমলাতান্ত্রিকতা, ভ্যাট ও করনীতির জটিলতা বিনিয়োগের অন্যতম বড় বাধা বলে মনে করেন উদ্যোক্তা ও সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া কারখানা স্থাপনের জমি বরাদ্দ পাওয়ার প্রক্রিয়াও বেশ জটিল। এতে আগ্রহ হারান উদ্যোক্তারা। অন্যদিকে দেশি ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য পৃথক ভ্যাট-করনীতিও বিনিয়োগকারীদের বাধার মুখে ফেলে দেয়। এ জন্য সহজ করনীতি, সহজ জমিপ্রাপ্তি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন ছাড়া দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিনিয়োগকারীরা। খোদ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটিও (বেজা) মনে করে, বিনিয়োগের জন্য দরকার সহজ করনীতি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ-সংক্রান্ত বৈঠকেও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এসব বাধার কথা উঠে এসেছে। জানা গেছে, সম্প্রতি চীন ও আমেরিকার মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধের জেরে চীন থেকে ৮৭টি জাপানি কোম্পানি বিনিয়োগ তুলে নিয়ে থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, মালয়েশিয়ার মতো দেশে গেলেও বাংলাদেশে আসেনি একটি কোম্পানিও। এমনকি সারা বিশ্ব যখন আইসিটি খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সম্প্রসারণ করছে, তখন আইসিটি খাতেও নতুন করে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারছে না সরকার। এর অন্যতম কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে অবকাঠামো দুর্বলতা, নীতির অস্পষ্টতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অনিয়ম-দুর্নীতি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অদক্ষতা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে নীতি-জটিলতা, অবকাঠামো সংকট আর বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব প্রকট। এজন্যই আমরা বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ হারাচ্ছি। এর চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, এখানে বিনিয়োগ করতে বা ব্যবসা করতে এলে কী ধরনের জটিলতা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হতে পারে সে সম্পর্কেও পরিষ্কার জানেন না বিদেশিরা। কী ধরনের জটিলতায় পড়তে হবে তা জানতে পারলে তাদের একটা প্রস্তুতি থাকত। কিন্তু আমরা তো তা পরিষ্কার করতে পারি না। আর আছে নীতির অনিশ্চয়তা। ফলে এটা বিদেশি বিনিয়োগের জন্য মারাত্মক হুমকি।’ সূত্র জানান, বর্তমানে করোনাভাইরাস প্রেক্ষাপটে স্থানান্তরিত বিনিয়োগ ধরতে না পারার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে দেশে কোনো ইনসেনটিভ বা প্রণোদনার ব্যবস্থা না থাকা। এ ছাড়া আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে ভেটিং না করে প্রকল্পের বা অন্য এজেন্সির সঙ্গে বিনিয়োগ-সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর, দেশি ও বিদেশি কোম্পানির মধ্যে করপোরেট করবৈষম্য, দেশি ও বিদেশি কোম্পানির জন্য ভিন্ন বিনিয়োগ নীতি, দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে ইতিবাচক ভাবমূর্তি ও ঘাটতি, পিপিপিতে বিনিয়োগ-সংক্রান্ত কর ও ভ্যাট জটিলতা, এনআরবি অ্যাকাউন্টধারী বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ ও মূলধন নিয়ে যাওয়া নিয়ে সমস্যা, ব্যাংকিং পদ্ধতিতে জটিলতা, অনিবাসীদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চ করহার, বিদ্যমান পলিসি বাস্তবায়নে জটিলতা এবং অনলাইনে ব্যাংক হিসাব খোলার সীমাবদ্ধতা। এদিকে বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগপ্রবাহ অস্বাভাবিক হারে কমে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাড। সংস্থাটি বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ৩০-৪০ শতাংশ কমে যেতে পারে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের মূল সমস্যাগুলো কী- এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ২৪ জুন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসের সভাপতিতে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জানা গেছে, চলমান করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে যেসব বিনিয়োগ স্থানান্তরিত হচ্ছে তা ধরতে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশ এরই মধ্যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। থাইল্যান্ড নতুন শিল্প স্থানান্তরের ক্ষেত্রে ১৩ বছরের জন্য কোনো জমির ভাড়া না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। একই রকম ঘোষণা দিয়েছে ইন্দোনেশিয়াও। কভিডের প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ট্যাক্স হলিডেসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েছে ফিলিপাইন, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম। এ ছাড়া নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর জমির কোনো ভাড়া নেবে না এমন ঘোষণা দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। অথচ বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বললেও এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি বাংলাদেশ।

জানা গেছে, বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক (বিএইচটিপি), বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোন কর্তৃপক্ষ (বেজা) এবং বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়া জোন (বেপজা) থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জমি দেওয়ার ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের জন্য ভাড়া মওকুফ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কেননা বাংলাদেশে বিনিয়োগ পলিসিগুলো দেশি ও বিদেশি কোম্পানির জন্য ভিন্ন। অনেক সময় কেস-টু-কেস ভিত্তিতে পলিসি করা হয়, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে। আবার এ কেস-টু-কেস শর্ত শিথিলের নীতি অনেক ক্ষেত্রে দেশীয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটির (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কর ও ভ্যাট নীতি আরও সহজ করা দরকার এটা তো আমরাও বলছি। এ ছাড়া জমি বরাদ্দের ব্যাপারে যত রকম জটিলতা রয়েছে তা দূর করার চেষ্টা করছে বেজা। এজন্যই সারা দেশে ১০০টি ইকোনমিক জোন তৈরি করা হচ্ছে। জাপান, কোরিয়া, চীনসহ বিনিয়োগকারী অন্য দেশগুলোকে পৃথকভাবে ইকোনমিক জোন বা জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে আরও অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’ এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে দেশি-বিদেশি উভয় ধরনের বিনিয়োগ বাড়বে বলে তিনি মনে করেন। এ ছাড়া রয়েছে প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অবকাঠামোর দুর্বলতা এবং নীতির অস্পষ্টতা। সাভারে চামড়া শিল্প নগরী গড়ে তোলা হলেও সেখানকার সিইটিপি ঠিকমতো কাজ করছে না। ফলে চামড়াশিল্প খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। একই অবস্থা বিরাজ করছে অন্যান্য খাতেও। তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের রপ্তানি-বাণিজ্যকে টিকিয়ে রাখলেও এ খাতেও নানা সংকট রয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষ, বেতন-ভাতা অনিয়মিতকরণ নিয়েও প্রায় সব সময়ই শ্রমিক বিক্ষোভ হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিও বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর