মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

জামিনে মুক্ত সিফাত তিন মামলা তদন্তে র‌্যাব

আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয় : সিনহার মা

নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা ও চট্টগ্রাম, কক্সবাজার প্রতিনিধি

জামিনে মুক্ত সিফাত তিন মামলা তদন্তে র‌্যাব

সংবাদ সম্মেলনে সিনহার মা

কক্সবাজারের টেকনাফে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার ঘটনায় স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সায়েদুল ইসলাম সিফাত জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। গতকাল বেলা সোয়া ২টায় তিনি কারা-ফটকে পৌঁছলে সাদা পোশাকধারী লোকজন তাকে দ্রুত নম্বরবিহীন একটি মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যায়। একই সঙ্গে পুলিশের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) পরিবর্তন করে র‌্যাবের হাতে তদন্তভার ন্যস্ত করতে করা আবেদনও মঞ্জুর করে আদালত। অন্যদিকে নিহত           মেজর (অব.) সিনহার মা নাসিমা আক্তার বলেছেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড যেন আর না হয়। আমার মতো আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়।’ গতকাল রাওয়া ক্লাবের নেতারা রাজধানীর উত্তরায় নিহত মেজর (অব.) সিনহার বাসায় গেলে তার মা এসব কথা বলেন।

জানা গেছে, গতকাল বেলা ১১টায় সিফাতের জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক তামান্না ফারাহ। এর আগে রবিবার দুপুরে জামিন পান সিনহার দলে থাকা আরেক সদস্য শিপ্রা দেবনাথ। সিফাত ও শিপ্রা স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ৩ জুলাই সিনহার সঙ্গে শিপ্রা, সিফাতসহ তিনজন কক্সবাজার গিয়েছিলেন ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ‘জাস্ট গো’ নামের ভ্রমণবিষয়ক ভিডিওচিত্র ধারণ করতে।

আদালত প্রাঙ্গণে সিফাতের পক্ষের জেলা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, ‘আমরা পুলিশের সাজানো মামলা থেকে সিফাতের মুক্তি এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করে র‌্যাবের কাছে হস্তান্তরের আবেদন জানিয়েছিলাম। বিচারক তামান্না ফারাহ পাঁচ হাজার টাকা জিম্মায় সিফাতকে জামিন দিয়েছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করে র‌্যাবে তদন্তভার ন্যস্ত করেছেন। সিনহা হত্যা মামলার একমাত্র সাক্ষী সিফাতকে র‌্যাব হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আইনি কোনো সমস্যা নেই।’

পরে সিফাতের মামা মাসুম বিল্লাহর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘সিফাত আমার সঙ্গেই আছে।’ কবে ঢাকায় ফিরবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন দেরি হবে।’ র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘শিপ্রা ও সিফাত তাদের নিকটাত্মীয়ের বাসায় রয়েছেন। তাদের সঙ্গে র‌্যাব ও তদন্ত কর্মকর্তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। সিফাত একটু মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তিনি খুব ট্রমার মধ্যে আছেন। এ জন্য আমরা একটু সময় নিচ্ছি। মানসিক চাপ কমলেই আমরা তার সঙ্গে কথা বলব।’

আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘‘শিপ্রার সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। শিপ্রা এ মর্মান্তিক ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চান। তবে তিনি স্পর্শকাতর অনেক তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এ ঘটনা আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। এটি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব।’ শিপ্রা ও সিফাত যদি কোনো ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন তবে তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আমরা সার্বক্ষণিক প্রস্তুত।’’

মামলায় অভিযুক্তদের রিমান্ড এবং সাক্ষ্য গ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে চার আসামিকে কারা-ফটকে দুই দিন জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। বাকি তিনজনের বিষয়ে আমরা একটু আস্তে-ধীরে এগোচ্ছি। মামলার কার্যক্রম আরেকটু গুছিয়ে রিমান্ডের আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদে এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন এবং আবদুল্লাহ আল মামুন অনেক চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে আবার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হবে।’

কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয় : মেজর (অব.) সিনহার মা নাসিমা আক্তার বলেছেন, ‘সিনহার বিষয়ে চলমান তদন্ত কার্যক্রমে আমি সন্তুষ্ট। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড যেন আর না হয়। আমার মতো আর কোনো মায়ের বুক যেন এভাবে খালি না হয়। ঘটনার রাতে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ আমাকে ফোন করে সিনহার বিষয়ে খোঁজখবর নেন। হত্যার পরদিন অর্থাৎ ঈদের দিন উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ আমাদের উত্তরার বাসভবনে আসেন। তারা সিনহার কর্মকান্ড ও রাজনৈতিক পরিচয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ নিয়ে চলে যান।’

গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার সময় নাসিমা আক্তার কান্নায় ভেঙে পড়েন। একপর্যায়ে তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘সিনহা সর্বদা বলত, আমি মানুষের জন্য কাজ করব, মানুষের হৃদয়ে থাকব। বলা নয়, কাজকর্মে বিশ্বাসী ছিল সিনহা। দেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে সব সময় চিন্তা করত সে। ছেলের (সিনহা) প্রতিটি কর্মকান্ডে আমার পূর্ণ সমর্থন ছিল। সর্বদা কাজ করে সারপ্রাইজ দিত সিনহা। টাকা উপার্জন তার মুখ্য বিষয় ছিল না, মনের খোরাকের জন্য কাজ করত।’

রাওয়া ক্লাবের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) খন্দকার নুরুল আফসার বলেন, ‘মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকান্ডের তদন্ত যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে আমরা সন্তুষ্ট। তবে বিচার প্রক্রিয়া যাতে দ্রুত হয় সেটি আমরা চাই। সিনহার ঘটনায় যারা কাস্টডিতে ছিলেন, তাদের জামিন হয়েছে। আমরা অত্যন্ত খুশি, আলহামদুলিল্লাহ। সিনহা হত্যায় যে পুলিশ সদস্যরা জড়িত ছিলেন, তাদের অস্ত্রগুলো যেন জব্দ করা হয়। হয়তো তদন্তের খাতিরে এটা করতেই হবে। যাদের ওপর তদন্তভার অর্পণ করা হয়েছে তারা অত্যন্ত দক্ষ।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করব তারা স্বচ্ছতা রক্ষা করবেন। কোনো পক্ষাবলম্বন করবেন না। হত্যার বিচার হলে সিনহার মা শান্তি পাবেন। ওসি প্রদীপ যেসব হত্যার সঙ্গে জড়িত, সেসব হত্যার বিচার করা হোক। পুলিশ বাহিনীকে সংস্কার করা হোক। এ ধরনের হত্যার যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়। রাওয়া কর্তৃপক্ষ মেজর (অব.) সিনহার বিচারিক তদন্ত কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে লে. জেনারেল (অব.) মইনুল ইসলামকে প্রধান করে একটি কমিটি করেছে।’ সিনহার বড় বোন ও হত্যা মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বলেন, ‘সিনহাকে আমি বলতাম, তুমি মানুষের হৃদয়ের রাজপুত্র (প্রিন্স অব পিপলস হার্ট)। এটা সে প্রমাণ করেছে তার ভালো ব্যবহার আর গুণাবলি দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন যে বিচার হবে। আমাদের একটাই দাবি, এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে যেন দ্রুতই বিচারটি হয়। এই বিচার যাতে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।’ প্রসঙ্গত, ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার সদরে যাওয়ার পথে বাহারছড়া পুলিশ চেকপোস্টে গাড়ি থেকে নামিয়ে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ৫ আগস্ট নয়জনকে অভিযুক্ত করে মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। এ ঘটনায় পুলিশ পরিদর্শক প্রদীপ কুমার দাশসহ অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বরখাস্ত করা হয়। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে র‌্যাব।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর