বুধবার, ১২ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

স্বাস্থ্য খাতে কাটেনি সমন্বয়হীনতা

জয়শ্রী ভাদুড়ী

স্বাস্থ্য খাতে কাটেনি সমন্বয়হীনতা

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধ ও আক্রান্তদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য খাতের সমন্বয়হীনতা দৃশ্যমান। রিজেন্ট, জেকেজির প্রতারণা, দুর্নীতি সামনে এলে শুরু হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-অধিদফতরের কাদা ছোড়াছুড়ি। সচিব-ডিজি পদে রদবদলেও কাটেনি স্বাস্থ্য খাতের সমন্বয়হীনতা। অবৈধ হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযানের পক্ষে সচিব জোরালো মত দিলেও মন্ত্রীর তাতে ঘোর আপত্তি। প্রজ্ঞাপনের স্মারক একই থাকলেও ১৭ দিনের মধ্যে মহাপরিচালক পদের সামনে যোগ হয়েছে ভারপ্রাপ্ত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এমন কর্মকান্ডকে সমন্বয়হীনতা ও দায়িত্বহীনতা বলছেন চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা। ঈদের তিন দিন আগে বিনা নোটিসে করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন শেষে আইসোলেশনে থাকা চিকিৎসকদের হোটেল ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে। সমালোচনার ঝড় উঠলে নোটিস স্থগিত করে ঈদের পরে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সেখানে করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসকদের নিজ দায়িত্বে আবাসনের ব্যবস্থা করতে বলে দৈনিক ভাতা ধরিয়ে দেওয়া হলো। এই সিদ্ধান্তে হুমকিতে পড়েছে ওই চিকিৎসক, তার পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট সবাই। রাতারাতি সিদ্ধান্তে রদবদল, সাংঘর্ষিক বক্তব্য, সমন্বয়হীন কাজের জন্য বারবার সমালোচনার মুখে পড়ছে দেশের স্বাস্থ্য খাত।  গত রবিবার বিএমএ নেতৃবৃন্দ এবং বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশের হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযান এক মিনিটের জন্যও বন্ধ হবে না। যে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ামাত্র টাস্কফোর্স সদস্যরা অভিযান পরিচালনা করবেন। এক্ষেত্রে জনগণের জন্য একটি টেলিফোন নম্বর দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সেই টেলিফোনের মাধ্যমে অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালে অনতিবিলম্বে সাড়া দেওয়া হবে। আগামী ২৩ আগস্টের মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে লাইসেন্স নবায়নের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে নবায়ন না করলে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই দিন মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘অভিযান কেন? হাসপাতালে অভিযান হবে না, ইনকোয়ারি (অনুসন্ধান) হবে। অভিযান তো হয় চিটাগাং হিল ট্র্যাকসে (পার্বত্য অঞ্চল), যেখানে সন্ত্রাসীরা থাকে। এককভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোথাও যাবে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করবে। প্রয়োজনে তাদেরকে নিয়ে সেখানে যাওয়া হবে। যেখানে (হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান) অনিয়ম ও দুর্নীতি হবে সেখানে স্বাস্থ্য এবং স্বরাষ্ট্র দুই মন্ত্রণালয় আলোচনা সাপেক্ষে আইনগতভাবে যা করা দরকার সে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের পরদিনই গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অভিযান পরিচালনা করেছে টাস্কফোর্স। নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ছিল হাসপাতালটির বিরুদ্ধে। করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালনকারী চিকিৎসকদের কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থার পরিবর্তে দৈনিক নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। ফলে কোয়ারেন্টাইন সময়ে বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে নিজ দায়িত্বে। করোনা রোগীদের সরাসরি সেবার দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকরা এ সিদ্ধান্তে পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। এ সিদ্ধান্ত অমানবিক ও অপমানজনক বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। এই স্বাস্থ্যকর্মীরা দায়িত্ব পালন শেষে গণপরিবহনে ফিরলে সংক্রমিত হতে পারেন আশপাশের মানুষ। নিজের বাড়িতে কোয়ারেন্টাইন পালন করলে উচ্চ ঝুঁকিতে থাকবে তাদের পরিবার। এ পর্যন্ত ৭৩ জন চিকিৎসক মারা গেছেন, আক্রান্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার। এ পরিস্থিতিতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছে বিএমওসহ অন্যান্য সংগঠন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। এরপরেই আরেক সিদ্ধান্তে সমালোচনার ঝড় বইছে স্বাস্থ্য অধিদফতর জুড়ে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক পদে গত ২৩ জুলাই নিয়োগ দেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মো. খুরশীদ আলমকে। ১৭ দিন পর তাকেই আবার ‘ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক’ হিসেবে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। দুই প্রজ্ঞাপনের স্বাক্ষরকারীর নাম ও তারিখ ভিন্ন হলেও স্মারক নম্বর একই। গত রবিবার রাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গত ২৩ জুলাই জারি করা প্রজ্ঞাপন পরিবর্তন করে নতুন একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এ প্রজ্ঞাপনে নিয়োগকৃত পদের নাম লেখা হয়েছে ‘মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত)’। কর্মস্থল লেখা হয়েছে ‘স্বাস্থ্য অধিদফতর’। এভাবে প্রতিনিয়ত সমালোচিত সমন্বয়হীন কর্মকান্ডের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে দেশের স্বাস্থ্য খাত।

সর্বশেষ খবর