বুধবার, ১২ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

দ্বৈত নীতিতেই হোঁচট খান বিনিয়োগকারীরা

মানিক মুনতাসির

প্রায় প্রতিবছরই করপোরেট কর হার পরিবর্তন করা হয়। যদিও এ বছর তার ব্যতিক্রম হয়েছে। আবার এই করপোরেট কর দেশি-বিদেশি কোম্পানির ক্ষেত্রেও ভিন্ন। এটাকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বৈষম্য বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এমন দ্বৈত নীতির ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীই হোঁচট খান বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া বিনিয়োগের জমি প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও রয়েছে একই বৈষম্য। আর ভ্যাট এবং ট্যাক্স হলিডের ক্ষেত্রে স্থায়ী কোনো নীতিও নেই। প্রায় প্রতিবছরই বাজেটের সময় ভ্যাটসহ এসব নীতির পরিবর্তন হয়। যা বিনিয়োগের অন্যতম বড় বাধা বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান। তিনি বলেন, বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য একটা স্থায়ী পলিসি থাকা উচিত। এটা পৃথিবীর প্রায় অনেক দেশেরই রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে খুব ঘন ঘন পলিসি পরিবর্তন করা হয়। বিশেষ করে ভ্যাটনীতি, করপোরেট কর, জমি প্রাপ্তি, ট্যাক্স হলিডেসহ আরও কয়েকটি  বিষয়ে একটা স্থায়ী পলিসি থাকা প্রয়োজন। অন্যদিকে প্রতিযোগী ও প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করপোরেট করহার উচ্চ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যা ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য এক ধরনের অন্তরায়। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে গবেষণাভিত্তিক কাজ করা বহুজাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান কেপিএমজি ইন্টারন্যাশনালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে করপোরেট কর যেসব দেশে বেশি তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ভারতে করপোরেট করহার ৩০ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় করপোরেট করহার ২৮ শতাংশ। তবে সিগারেট ও মদ আমদানি ও উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই হার ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে বিদেশি কোম্পানিকে নিজেদের দেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে বাড়তি ১০ শতাংশ রেমিট্যান্স কর দিতে হয়। আফগানিস্তানের করপোরেট করহার বাংলাদেশের চেয়ে কম; ২০ শতাংশ। তবে কেপিএমজির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ৫৫ শতাংশ করপোরেট কর সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভিয়েতনামের কোম্পানি পর্যায়ে করর্পোরেট করহার ২০ শতাংশ। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম কর্তৃপক্ষ করপোরেট করে ছাড় দেয় সব সময়। এ ছাড়া মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়ায় ২৫ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ২৪ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ১৭ শতাংশ করপোরেট কর বিদ্যমান।

এনবিআরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে সাত স্তরে করপোরেট কর আদায় হয়। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির ক্ষেত্রে পৃথক হার রয়েছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানি ২৫ শতাংশ, তালিকাবহির্ভূত কোম্পানি ৩২.৫ শতাংশ, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির জন্য ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ২.৫০ শতাংশ কর কমানো হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংক, লিজিং, বীমাসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মোবাইল ফোন কোম্পানি এবং সিগারেট প্রস্তুতকারী কোম্পানি ছাড়া শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ২৫ শতাংশ। আর তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির করহার ৩৫ শতাংশ। এই কর কাঠামো ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট সহায়ক নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জমি প্রাপ্তি সংক্রান্ত যেসব জটিলতা রয়েছে আমরা সেগুলো দূর করার চেষ্টা করছি। আমরা বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিচ্ছি। নীতি ও পলিসি বা কর্মপন্থা সংক্রান্ত কিছু জটিলতা থাকে যেগুলো আরও সহজ করা প্রয়োজন। কোনো বিদেশি কোম্পানি অন্য কোনো দেশে বিনিয়োগ করতে গেলে সবার আগে চিন্তা করে সে কতটুকু প্রফিট পাবে। পাশাপাশি কী ধরনের ফ্যাসিলিটি পাবে। যেমন ভ্যাটনীতি, করপোরেট কর, ট্যাক্স হলিডে- এসব বিষয়ে সবার নজর থাকে। ফলে এগুলোর ব্যাপারে স্থায়ী নীতি থাকলে বিনিয়োগ প্রক্রিয়া অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। এসব বিষয়ে আগে অনেক জটিলতা ছিল। বর্তমান সরকার সেগুলো দূূর করছে বলে তিনি মনে করেন। জানা গেছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিয়েই বিশ্বব্যাংক সহজে ব্যবসা করার সূচক প্রকাশ করে থাকে। এই সূচকে বাংলাদেশ রয়েছে তলানীতে। অথচ ভারত, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড এমন কি ফিলিপিনও এই সূচকে বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। এই সূচকের তালিকায় থাকা ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম। ভিয়েতনাম ৭০তম। থাইল্যান্ড ২১তম আর মিয়ানমারও বাংলাদেশের তুলনায় তিন ধাপ এগিয়ে রয়েছে। ফলে যে কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী এ দেশে আসতে চাইলে এই সূচকেও দৃষ্টি রাখে। যা বাংলাদেশে বিনিয়োগের বেলায় চিন্তার শুরুতেই তারা ধাক্কা খান বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সর্বশেষ খবর