প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মানুষের জন্য আমার সাধ্যের সবটুকু উজাড় করে যাব। মানুষ একটা শোক সইতে পারে না। আর আমরা কীভাবে সহ্য করে আছি। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সব শোক ভুলে আছি। শুধু এটা চিন্তা করে যে, এই দেশটা আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। তিনি (বঙ্গবন্ধু) দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তাই মানুষের জন্য কিছু করে যেতে চাই যেন বঙ্গবন্ধুর আত্মা শান্তি পায়। গতকাল সকালে ৫০ হাজার বার পবিত্র কোরআন খতম এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত দোয়া মাহফিলে তিনি এ কথা বলেন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সমাজসেবা অধিদফতর মিলনায়তনে সংস্থাটির আয়োজনে এ দোয়া মাহফিলে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ গড়তে চেয়েছিলেন। এ দেশকে করতে চেয়েছিলেন সোনার বাংলা। ঘাতকরা তাঁকে সে সময় দেয়নি। কিন্তু আমি আমার সবটুকু সাধ্য দিয়ে কাজ করে যাব তাঁর সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে, যাতে তাঁর আত্মা শান্তি পায় এবং রক্ত বৃথা না যায়। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিচার পাওয়ার সুযোগ ছিল না। আমরা বিচার চাইতে পারিনি। আইন করে এই হত্যাকান্ডের বিচার বন্ধ করা হলো। প্রতিটি হত্যায় জড়িত খুনিরা যেন পার না পায় আমি সেই পরিবর্তন আনতে চাই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছে তারা ঘৃণ্য। ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে তাদের বিচার করতে পেরেছি। এতে আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করি। কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশের মানুষকে, যারা আমাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। আমার দল আওয়ামী লীগসহ কার্যত আমার পাশে থেকেই আমাকে শক্তি জুগিয়েছে একটা পরিবারের মতো। মিলাদে অংশ নেওয়া এতিম শিশুদের উদ্দেশে সরকারপ্রধান বলেন, নিজেরা এতিম হয়েছি বলে এতিমের কষ্টটা আমরা বুঝি। বাবা-মা না থাকার কষ্টটা আমি বুঝি। এই কষ্ট আরও বুঝলাম ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট। একদিন সকালে উঠে যখন শুনলাম আমাদের কেউ নেই। এই ১৫ আগস্ট আমি হারিয়েছি আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যিনি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। আমার মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব সব সময় ছায়ার মতো বাবার সঙ্গে ছিলেন। শেখ হাসিনা বলেন, আমার চেয়ে দুই বছরের ছোট ছিল ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, মুক্তিযোদ্ধা ছিল। খুনিরা তাকে হত্যা করে। তার নবপরিণীতা বধূ সুলতানা কামালকেও হত্যা করে। যার হাতের মেহেদীর রং তখনো মোছেনি। তার ছোট লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, সে সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। তাকেও এই খুনিরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। হত্যা করেছিল তারও নবপরিণীতা বধূ রোজী জামালকে। যে আমার ছোট ফুফুর মেয়ে ছিল। অনেক শখ করে তাকে ঘরে আনা হয়েছিল। আমার একমাত্র চাচা শেখ আবু নাসের। তিনিও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, পঙ্গু ছিলেন। তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আবেগাক্রান্ত হয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ছোট ভাইটি শেখ রাসেল। আমি এখনো এই প্রশ্নের উত্তর পাই না। তার মাত্র ১০ বছর বয়স। তার জীবনের স্বপ্ন ছিল সে একদিন সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। তাকে সেই সেনাবাহিনীর সদস্যরাই নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করল। তার অপরাধ কী? শেখ হাসিনা বলেন, আমি আর আমার ছোট বোন বিদেশে ছিলাম। আমার স্বামী তখন জার্মানিতে। আমি সেখানে গিয়েছিলাম অল্প কিছু দিনের জন্য। কিন্তু আর দেশে ফিরতে পারিনি। ছয় বছর আমাদের দেশে আসতে দেওয়া হয়নি। আমার বাবার লাশও দেখতে পারিনি। কবরও জিয়ারত করতে পারিনি। এতিম হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে বিদেশের মাটিতে রিফিউজি হয়ে থাকার যে কী কষ্ট এটা আমাদের মতো যারা ছিল তারা জানে। শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ আগস্টের খুনিদের আইন করে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। নারী হত্যাকারী, শিশু হত্যাকারী, রাষ্ট্রপতি হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করা হয়। আমি সেই অবস্থা থেকে পরিবর্তন আনতে চাই। এদেশে সব মানুষ যেন নিরাপদে থাকতে পারে, সব মানুষ যেন সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে। মানুষের অধিকার যেন সমুন্নত থাকে সেদিকে আমরা লক্ষ্য রাখি। এতিমদের উদ্দেশে সরকারপ্রধান বলেন, তোমরা যারা এতিম তাদের ব্যথা আমরা বুঝি। তোমরা একা নও। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন তোমাদের পাশে আমি আছি। তোমাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তোমরা প্রতিটি শিশু যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পার- এ জন্য তোমাদের ভোকেশনাল ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। বাবা-মা কারও চিরকাল থাকে না। তোমরা মানুষ হতে পারলে তোমরাও একদিন এতিমদের পাশে দাঁড়াতে পারবে। তিনি বলেন, আমি এবং আমার ছোট বোন শেখ রেহানা সব সময় তোমাদের মতো এতিম এবং অসহায়দের কথা ভাবি। এ জন্য তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কীভাবে দেওয়া যায় আমরা সে চিন্তা করি। তাদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়ন করেছি। আমাদের জীবনে তোমরাই সবচেয়ে আপনজন। এ জন্য আমাদের পরিবারে যে কারও জন্মদিনে আমরা বাইরে বড় করে অনুষ্ঠান না করে তোমাদের মতো এতিমদের কাছে আমরা মিষ্টি ও খাবার পাঠাই। সমাজসেবা অধিদফতর প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন- সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ও প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু। গণভবন প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।