শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু : এক মৃত্যুঞ্জয়ী মহাপ্রাণ

নূরে আলম সিদ্দিকী

বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ, তার বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতায় যাদের অথবা যাদের পূর্বসূরিদের অবদান আছে, পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে এ রক্তস্নাত বাংলার যে দামাল ছেলেরা অভিষিক্ত, যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে; ৪৭ থেকে ৭১- এ দীর্ঘ পথপরিক্রমণে একেকটি আন্দোলনের সোপান উত্তরণের মাঝে একেক গুচ্ছ তরুণ তাজা তপ্ত প্রাণ অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। কিন্তু এ সবকিছুরই পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ প্রতীক ছিলেন জাতির জনক, আমার প্রাণের মুজিব ভাই। আগস্ট মাসটি বাঙালি জাতির তথা বাংলাদেশের জন্য শোকের মাস। কিন্তু আমার জন্য এটি হৃদয়ের রক্তক্ষরণের মাস; অনুভূতি, উপলব্ধি ও মননশীলতার পরতে পরতে অসহ্য ও তীক্ষè যন্ত্রণা সহ্য করার মাস। আজকে ৪৫ বছর হলো, মুজিব ভাই আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু আমার অনুভূতিতে, বিশ্বাসে এটা আজও পুরোপুরি সত্যরূপে প্রতিভাত হয় না। আমার মননশীলতা, অনুভূতি, হৃদয়ের অনুরণন, কোনো জায়গায় বঙ্গবন্ধু নেই বা তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন- এটা মানতে পারে না। আমার স্বপ্নের মধ্যে তো বটেই, জাগরণেও তার উপস্থিতি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করি। এ অনুভূতি কাউকে বোঝানো যাবে না, বোঝানো যায় না। আমার হৃদয়ের নিভৃত কন্দরে তিনি অমলিন। তাঁর সঙ্গে সব স্মৃতি আমার হৃদয়ে নিত্য জাগ্রত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এ বছরটিকে মুজিববর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। শোকাবহ আগস্টে আমার প্রাণের মুজিব ভাইয়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। ১৫ আগস্টের সেই নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকান্ডে নিহত বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সব সদস্যের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে রাখি, দীর্ঘ কারারুদ্ধ জীবনের মধ্যে ১৭টি মাস প্রত্যহ এত দীর্ঘ সময় ধরে আমি যে তার নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছি, বাস্তবে কারাগারের বাইরে অথবা ভিতরে অনুজ তার অগ্রজের, সন্তান তার পিতার এত নিবিড় সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য হয় না। যেটি আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার হয়েছে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ¯œাতকোত্তর ডিগ্রিধারী উদ্ধত উদ্গত পূর্ণায়ত পদ্মটির মতো উদ্ভাসিত যৌবনের অধিকারী। আজকের যুবকেরা সেটি অনুধাবন করতে অক্ষম, এটি আমি শতভাগ নিশ্চিত। তখন আমাদের পুরো জীবনটা, চেতনার সব অংশটুকু রাজনীতির সমুদ্রের অতলান্তে নিমজ্জিত। এমনকি ব্যক্তিগত জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, চাওয়া-পাওয়া সবকিছুই ছিল রাজনৈতিক চেতনার গভীরে নিমগ্ন। বাংলার স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের কল্পনার আবর্তে আর কোনোকিছুই তখন দোলা দিত না। এই যে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরণ- এর অগ্রভাগে ছিলেন মুজিব ভাই। তিনি ছিলেন আন্দোলনের স্থপতি। তাঁর কালজয়ী নেতৃত্বকে ঘিরেই আবর্তিত হয় প্রতিটি আন্দোলনের স্রোতধারা। এ স্রোতধারার স্রষ্টা ছিল ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধুকে বহুজনের মধ্য থেকে একক নেতৃত্বে প্রতিস্থাপিত করার পূর্ণ কৃতিত্ব ছাত্রলীগের। রাজনৈতিক চেতনা হিসেবে আমাদের চিন্তায়, মননশীলতায় সুরের মূর্ছনা তুলতো- ‘এ মাটি আমার সোনা, আমি করি তার জন্মবৃত্তান্ত ঘোষণা’, ‘সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি যে আছে মাটির কাছাকাছি’, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’। লাহোরে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে যখন আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে আইয়ুবকে উৎখাত করার জন্য পাকিস্তানের সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সর্বদলীয় কর্মসূচি গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেই সম্মেলনের প্রারম্ভে বঙ্গবন্ধু তখনকার পূর্ব-পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশের তরফ থেকে ৬ দফা কর্মসূচিকে আন্দোলনের প্রধান কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করার দাবি তোলেন। মুজিব ভাই তখন এতটাই প্রদীপ্ত ও অকুতোভয় মানসিকতায় উজ্জীবিত ছিলেন যে, ৬ দফা স্বাধীনতার উপক্রমণিকা- এটি তাঁর প্রতীতি ও প্রত্যয়ে পরিণত হয়।

৬ দফা প্রদানের প্রাক্কালে তখনকার শেখ মুজিবুর রহমান এমনকি পূর্ব পাকিস্তানেও অনেক নেতার মধ্যে অন্যতম ছিলেন। কিন্তু ৬ দফার দাবি উপস্থাপনের পর ছাত্রলীগের নিরলস ও নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলনের বিস্তীর্ণ পথপরিক্রমণের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ তাকে বাংলার মানুষের হৃদয়ের সিংহাসনে মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, স্থপতি, মূর্তপ্রতীক। আর একে বাস্তবায়িত করার সুদক্ষ রাজনৈতিক সৈনিক ও প্রতিস্থাপনের মূল কারিগর সন্দেহাতীতভাবে ছাত্রলীগ ও তাঁর নেতৃত্ব।

খুব সম্ভবত ১৯৫৭ সালে ঝিনাইদহে সাংগঠনিক সফরে গেলে তাঁর মধ্যাহ্নভোজনের ব্যবস্থা ছিল আমাদের বাসায়। তাঁর খাওয়ার থালায় স্থান সংকুলান হবে না বলে একটি খাঞ্চায় করে একটি ১০/১২ কেজি ওজনের রুই মাছের সম্পূর্ণ মাথা তাঁকে পরিবেশন করা হয়েছিল। তিনি সেখান থেকে ভেঙে ভেঙে তাঁর সতীর্থদের দিয়েছিলেন। মাছের মাথাটি তিনি অত্যন্ত পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেয়েছিলেন, এটি আমি বুঝতে পেরেছি। তিনি যখন আমাকে কাছে ডাকলেন, তখন আদৌ বোধগম্য হয়নি যে, ওই মাছের মাথা থেকে তিনি আমাকেও স্নেহ খাওয়াবেন। আমি বিমুগ্ধ হলাম, বিমোহিত হলাম, বিস্মিত হলাম। সেদিন থেকেই এ মহান ব্যক্তিত্বটির প্রতি আমার বিমুগ্ধ, বিমোহিত ও বিস্মিত চিত্তের অনবদ্য আকর্ষণ তৈরি হয়।

তারপর ৬১ সালে আমি ঢাকায় চলে আসি। পারিবারিক সূত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমার যে আশৈশব বন্ধন, সেটি ঢাকায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন জানত। আমার সঙ্গীসাথীরা, সহপাঠী অথবা ব্যক্তিগত পর্যায়ের বন্ধুরা সবাই সুস্পষ্টভাবে জানত, আমি আওয়ামী লীগ ঘরানার লোক। আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হলে ওখানকার ছাত্রলীগ সংগঠিত করার দায়িত্ব দেন স্বয়ং মোয়াজ্জেম ভাই। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, মোয়াজ্জেম ভাই কোনো হলে আবাসিকভাবে থাকতেন না। যেখানে থাকতেন, সেই বাড়িটির নাম ছিল ‘নিম ভিলা’। ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের তদানীন্তন নেতৃবৃন্দ নাসির ভাই, আনিস ভাই, কেন্দ্রীয় নেতা শহীদুল হক মুন্সী, আজমত আলী শিকদার ভাই আন্তরিকতা ও সহযোগিতায় আমাকে নিম ভিলায় নিয়ে যেতেন।

এরপর থেকে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে (পুরানা পল্টন) মাঝে মাঝেই যেতাম এবং মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো। জনান্তিকে জানিয়ে রাখা ভালো, যখন মুজিব ভাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতি হলেন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, তাঁদের দুজনের মধ্যে গভীর আন্তরিকতার কারণে এবং মুজিব ভাইয়ের অনন্যসাধারণ সাংগঠনিক শক্তির বদৌলতে আওয়ামী লীগ এককভাবে বঙ্গবন্ধুর হাতে থাকার কারণে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ সাংগঠনিকভাবে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতেন ও তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করতেন।

আমি অনেকবার কারাগারে যাওয়া-আসার কারণে আমাকে অনেকেই বি ক্লাস বলতেন। মামলায় বারবার জেলখানায় যাওয়া-আসা করলে, সে শাস্তি নিয়েই হোক অথবা বিভিন্ন মামলার জামিনযোগ্য আসামি হিসেবেই হোক, জেলখানার পরিভাষায় তাকে বি ক্লাস আসামি বলা হতো। বি ক্লাস হওয়া সত্ত্বেও আমি আগে কখনো নিরাপত্তা বন্দী বা রাজবন্দী ছিলাম না। ৬৬ সালের ৯ জুন আমি ডিপিআরে রাজবন্দী হিসেবে কারাগারে ঢুকি এবং আমাকে কারাগারের পুরনো ২০ সেলে স্থান দেওয়া হয়। এর সন্নিকটেই ছিল দেওয়ানী, যেখানে কারাগারে মুজিব ভাইয়ের অবস্থান ছিল। দেওয়ানীর পাশেই ছোট্ট একটি রান্নাঘর, যেটি একান্তভাবেই মুজিব ভাইয়ের জন্য ব্যবহৃত হতো। সেবার যখন আমাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললেন, ‘বারবার ঘু-ঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এইবার ঘু-ঘু তব বধিবে পরাণ’। তিনি দ্রুত এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং নিচু স্বরে বললেন, প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে, পরে সয়ে যাবে। তাঁর সেই সান্ত্বনার বাণীতে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। কারণ বি ক্লাস থেকে নিরাপত্তা বন্দী হয়ে জাতে উঠেছি। আর মুজিব ভাই-ই নন, নিরাপত্তা বন্দীরাই কুলীন ছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে কারাগার থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার আগ পর্যন্ত ১৭টি মাস তাঁর নিবিড় সাহচর্য ও সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তারপর ১৯৬৯ সালের শেষার্ধে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হই এবং তাঁরই নির্দেশে একাত্তরে ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি, যার প্রতিটি সভায় সভাপতিত্ব করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এসব দায়িত্ব পালনের সুবাদে স্বাভাবিকভাবেই মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে। তাঁর অপার স্নেহে আমি সিক্ত হয়েছি। এছাড়া পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি আমাকে চাপ সৃষ্টি করেন এবং আমি আমার এলাকা ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হই। বাকশালের বিরোধিতা করা সত্ত্বেও ১৫ আগস্টের পর আমাকে গ্রেফতার করে দীর্ঘদিন ক্যান্টনমেন্টে তারপর কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯ মাস বন্দী করে রাখা হয়েছিল (রিট করে বেরিয়ে আসি)। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া, আমার একটাই সান্ত্বনা এই যে, ১৫ আগস্টে প্রতিরোধ গড়তে না পারলেও নেতার একান্ত বিশ্বস্ত সহকর্মী হিসেবে কারাভোগের মাধ্যমে নেতার প্রতি কিছুটা ঋণ শোধ করতে পেরেছি। এবং সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর চিন্তা-চেতনা, আদর্শ ও মননশীলতার বাইরে যেতে পারিনি।

লেখক : স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতা ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর