রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা
ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) মাজেদের জবানবন্দি

খুনিদের সঙ্গে বঙ্গভবনে দেখা করতেন জিয়া

সাখাওয়াত কাওসার

খুনিদের সঙ্গে বঙ্গভবনে দেখা করতেন জিয়া

ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদ

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খুনিদের সবাই বঙ্গভবনে আশ্রয় নেন। বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের পাশের ভিআইপি স্যুটে (দ্বিতীয় তলা) তারা অবস্থান করতেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান নিয়মিত সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করতেন। নারকীয় এই হত্যাকান্ডের পুরস্কার হিসেবে খুনিদের একটি করে পদোন্নতি এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে চাকরি দেওয়া হয়। তাদের সব চাহিদা পূরণে দেখভাল করতেন খোদ জিয়াউর রহমান। তাদের পরামর্শেই মূলত সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সবকিছু চলত। গত বছর ১২ এপ্রিল ঢাকার কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আগে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন বঙ্গবন্ধুর খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদ। তার জবানিতে বেরিয়ে এসেছে আরও অনেক চাঞ্চল্যকর অজানা কাহিনি। গত বছর ৮ এপ্রিল গভীর রাতে রাজধানীর গাবতলী এলাকা থেকে খুনি মাজেদকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২২ থেকে ২৩ বছর ধরে পরিচয় গোপন করে তিনি কলকাতায় ছিলেন বলে জানায় পুলিশ। গতকাল সকালে বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনলাইনে জবানবন্দির একটি ভিডিও ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তা ভাইরাল হয়ে যায়। দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা বাংলাদেশিদের চিন্তাধারায় নতুন করে ধাক্কা দেয় মাজেদের জবানবন্দি।

জবানবন্দিতে ইতিহাসের গর্হিত এই হত্যাকান্ডে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বারবার আড়াল করার চেষ্টা করে গেছেন মাজেদ। তবে খুনিদের দেওয়া সব ধরনের সুবিধা কেন ভোগ করেছেন এর কোনো উত্তর দেননি। বারবার বলার চেষ্টা করেছেন, জুনিয়র অফিসার থাকার কারণে তিনি সবকিছু জানতেন না। সিনিয়রদের নির্দেশেই তিনি সবকিছুতে অংশ নিয়েছেন। বঙ্গভবনের স্কটের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সেনেগালের রাষ্ট্রদূত হিসেবে তার পোস্টিং হলেও সেনেগাল তার পছন্দ হয়নি। পরবর্তী সময়ে ১৯৮০ সালে মাজেদের ইচ্ছানুযায়ী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে উপসচিব পদমর্যাদায় বিআইডব্লিউটিসিতে পদায়ন করেন। সব শেষ যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ে পরিচালক করা হয় মাজেদকে।

ফাঁসির আগে দেওয়া দীর্ঘ জবানবন্দিতে এই খুনি উল্লেখ করেছেন, খুনিদের সব ধরনের কাজেরই বৈধতা দেওয়া হয়। মূলত তাদের মাধ্যমেই সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পান জিয়াউর রহমান। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপ্রধান হন। খুনি মেজর (বরখাস্ত) শাহরিয়ার অন্য একজনের স্ত্রীকে ভাগিয়ে নিয়ে লিবিয়ায় চলে যান। মেজর বজলুল হুদা বিয়ে না করেই নারায়ণগঞ্জের এক মেয়েকে নিয়ে লিবিয়ায় যান। পরবর্তী সময়ে সেনা তত্ত্বাবধানে তাদের কাগজপত্র তৈরি করে লিবিয়ায় পাঠানো হয়।

১৫ আগস্ট কালরাতের বিষয়ে মাজেদ উল্লেখ করেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে। এর পর থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর নজরদারি করে খুনিরা। এরই অংশ হিসেবে আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় মাঝেমধ্যেই ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতেন মাজেদ। অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে তিনিও খুনিদের সঙ্গে ছিলেন। সবাই বঙ্গবন্ধুর সেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে ঢুকলেও এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী প্রথম বঙ্গবন্ধুকে গুলি করেন। তারপর রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্য সদস্যদের একে একে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেন। পরদিন স্টেশন সদর দফতরে গিয়ে তৎকালীন স্টেশন কমান্ডার কর্নেল হামিদের সঙ্গে দেখা করে ইউনিটে যোগ দিতে চাইলেও কর্নেল হামিদ তাকে যোগদান করতে না দিয়ে বেতার ভবনে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

ইতিহাসের ওই নারকীয় হত্যাযজ্ঞে তৎকালীন জিয়াউর রহমানের পরোক্ষ সমর্থন ছিল উল্লেখ করে মাজেদ বলেন, ‘আগের রাতে হত্যাযজ্ঞ শেষে পরদিন পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জিয়াউর রহমান সাহেব সকাল ১০টা-১১টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট অডিটরিয়ামে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সব জওয়ান ও অফিসারকে অ্যাড্রেস করেন। ওইখানে উনি (জিয়াউর রহমান) মটিভেট করেন, যে ঘটনা গত রাতে ঘটে গেছে তোমরা সেসব নিয়ে কোনো রকম মাথা ঘামাবে না। তোমরা সব চেইন অব কমান্ডে ফিরে যাও। সবাই কাজকর্ম করো। এটা জাতির ব্যাপার, এটা আমাদের ব্যাপার নয়।’

মাজেদ বলেন, তখন বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটা সিপাহিও ক্যুর বিষয়ে জানতেন না। তাদের কোনো অফিসারও এতে ইনভলবড ছিলেন না। তবে ওই বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুজন-তিনজন রিটায়ার্ড অফিসার ছিলেন। আর বাকিরা ট্যাংক রেজিমেন্ট, আর্মার্ড কোরের লোক। তিনি (জিয়াউর রহমান) বক্তৃতা দিয়েছেন, মটিভেট করেছেন। সমর্থন না থাকলে আগ বাড়িয়ে তিনি করতে যাবেন কেন? রেগুলার ওরাই ডিক্টেক্ট করত সবকিছু। হুকুম চালাত ওইখান থেকে। ওরা যা-ই চাইত তা-ই উনি করে দিতেন।

আর্মির চেইন অব কমান্ড ছিল না উল্লেখ করে মাজেদ বলেন, ‘উনি (জিয়াউর রহমান) বঙ্গভবনে খুনিদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন এবং খুনিরাও তার সঙ্গে ওইখান থেকে যোগাযোগ করতেন ডাইরেক্ট। তখন আর্মির চেইন অব কমান্ড বলতে কিছু ছিল না। ওরাই চালাতেন প্র্যাকটিকালি। ওইখান থেকে। মাঝখানে সেনা হেডকোয়ার্টারে একবার আমি ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে উনাকে (জিয়াউর রহমান) আমার জন্য একটি সিভিল সার্ভিসের ব্যাপারে অনুরোধ করেছিলাম। ইন্টারভিউতে তিনি (জিয়াউর রহমান) প্র্যাকটিকালি এই ক্যুর ব্যাপারে পক্ষপাতসুলভ কথাবার্তা বলছেন। বোঝা গেছে, ক্যুর সমর্থকদের সঙ্গে উনার (জিয়াউর রহমান) সব ধরনের যোগাযোগ ছিল।’

বিদেশে মিশনে চাকরির বিষয়ে মাজেদ বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে যখন বিদেশে যাওয়ার প্রশ্ন এলো, তখন তিনি (জিয়াউর রহমান) দফায় দফায় বঙ্গভবনে মিলিটারি সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। এগুলো আমরা দূরে থেকে দেখেছি। পরে (জিয়াউর রহমান) বললেন, এখানে (বঙ্গভবনে) যে সমস্ত অফিসার আছে তারা সবাই বিদেশে যাবে। তাদের কাগজপত্র তৈরি করার জন্য তৎকালীন মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার মাশহুর হককে নির্দেশ দেন তিনি। ওই সময় আমি বঙ্গভবনে স্কট ডিউটিতে ছিলাম। পরবর্তী সময়ে আমাদের ব্যাংককে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে যাওয়ার পরই জিয়াউর রহমান সাহেব পুরো ক্ষমতা নিয়ে নেন। কিছুদিন পর আমাদের লিবিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে আমরা শুনলাম রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে মেরে ফেলা হয়েছে। রিসালদার বলছিল, তার সঙ্গে দুইটা সিপাইও ছিল। সিপাইরা তো ওইখানে যাওয়ার কথা নয়।’

জবানবন্দিতে মাজেদ উল্লেখ করেন, ‘লিবিয়ায় যাওয়ার পরে বলা হলো সবার ফরেইন সার্ভিস হবে। পুরস্কার হিসেবে জিয়াউর রহমান সবাইকে ফরেইন সার্ভিস দেবেন। একটা করে প্রমোশনও দিয়ে দেবেন। কিছুদিন পরে (আমার একজ্যাক্ট ডেইট মনে নাই) জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতিনিধি হিসেবে জেনারেল নুরুল ইসলামকে (শিশু) আমাদের কাছে পাঠানো হয়। কার কার কোথায় ফরেইন পোস্টিং হবে সেই চয়েজ নিতেই তিনি গেছেন ওইখানে।’

বিদেশি মিশনে চাকরিপ্রাপ্ত অনেকেরই যোগ্যতা ছিল না জানিয়ে মাজেদ বলেন, ‘উনার (জিয়াউর রহমান) সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই তাদের একটা করে প্রমোশন জাম্পড এবং একটা করে ফরেইন প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল। তবে ওই অফিসারদের অনেকেই ফরেইন সার্ভিসের জন্য কোয়ালিফাইড ছিলেন না, এমনকি কেউ কেউ গ্র্যাজুয়েটও ছিলেন না। তাদের বেশির ভাগই স্বল্পমেয়াদি কমিশনড অফিসার ছিলেন। তাদের (ক্যু অফিসারের পরিবার) বঙ্গভবন থেকেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল লিবিয়ায়। অনেকে বিয়ে না করেও তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে গেছেন। মেজর শাহরিয়ার অন্যের স্ত্রীকে নিয়ে চলে যান। মেজর হুদা নারায়ণগঞ্জের এক মেয়েকে বিয়ে না করেই সঙ্গে নিয়ে যান। পরে এসব অবৈধ কাজের বৈধ কাগজপত্র তৈরি করে লিবিয়ায় পাঠানো হয়।’

ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ প্রসঙ্গে মাজেদ বলেন, ‘খুনিদের বঙ্গভবনে অবস্থানের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। আমরা শুনেছি যে উনি (শহীদ খালেদ মোশাররফ) বলছেন, ওই মেজররা শুধু শুধু বঙ্গভবনে বসে থাকবে কেন? তারা চলে আসবে। ইউনিটে চলে আসবে। তারা কমান্ডে ফিরে আসবে। ওইটা তার (খালেদ মোশাররফের) একটা ন্যায্য দাবি। সঠিক দাবি। চেইন অব কমান্ড। চেইন অব কমান্ড ছাড়া ফোর্স চলে নাকি? তবে শহীদ খালেদ মোশাররফকে যারা শহীদ করেছে, তাদের পেছনেও ক্যু পার্টির সমর্থন ছিল। জিয়াউর রহমান এলে ডাইরেক্ট লিফট দিয়ে দোতলায় উঠে (ভিআইপি স্যুইট) যেতেন। সেখানেই ক্যু পার্টির সঙ্গে তার কথোপকথন হইত।’

প্রসঙ্গত, গত বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি ও মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকরের আগে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।

মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনি এখনো পালিয়ে আছেন। তাদের মধ্যে এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী কানাডায় এবং এ এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। অন্য তিনজন খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম ও মোসলেহ উদ্দিনের অবস্থান সম্পর্কে সরকারের কাছে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। এ ছাড়া ফাঁসির দন্ডাদেশপ্রাপ্ত আরেক আসামি আজিজ পাশা ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর