রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

জিয়া আমাকে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল : রাষ্ট্রপতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

জিয়া আমাকে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল : রাষ্ট্রপতি

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান আমাকে মন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। আমি যদি প্রস্তাবে রাজি না হই তাহলে আমাকে ২৫ বছর জেলবন্দী রাখার হুমকি দেওয়া হয়েছিল।

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে দেওয়া রেকর্ডকৃত এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, কর্নেল মাহফুজুর রহমানের মাধ্যমে জিয়া আমাকে মন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ জিয়াউর রহমানের প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমি ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জের এক আলোচনা সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করি। বক্তৃতায়  আমি বলেছিলাম, হিটলার-মুসোলিনি থেকে শুরু করে কোনো স্বৈরাচারই টেকেনি, এ দেশেও স্বৈরাচার টিকবে না। এ সময় তিনি জেলখানায় দুর্বিষহ কষ্টের ইঙ্গিত দেন। তৎকালীন ছাত্রনেতা ও তরুণ এমপি আবদুল হামিদ আরও বলেন, এ অপরাধেই বোধ হয় কিছুদিন পর আমি গ্রেফতার হই। জেলখানার ভিতরেই জিয়াউর রহমান তার সামরিক সচিব কর্নেল মাহফুজুর রহমানের মাধ্যমে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পাঠায়। বলা হয়েছিল, প্রস্তাব না মানলে ২৫ বছর জেলে থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেইমানি করতে পারিনি বলে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিই। জীবনভর বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবে তাঁর আদর্শ আঁকড়ে ধরেই থাকতে চেয়েছি। রাষ্ট্রপতি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতা ও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল। ইতিহাসের নারকীয় হত্যাকান্ডের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে ঘাতক চক্র কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি আইন’ পাস করে। তিনি বলেন, ১৫ আগস্টের বর্বরোচিত ঘটনা কেবল বাঙালির ইতিহাসের নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল। ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র পরাজিত হলেও দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে তাদের চক্রান্ত কখনো থেমে থাকেনি। স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ঘাতক চক্রের চক্রান্তের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশই হচ্ছে ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকান্ড।

রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদাতবার্ষিকীতে আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। শোকাহত চিত্তে আরও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তাঁর তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ শহীদদের প্রতি, যাঁরা ১৯৭৫ সালের এ দিনে ঘাতক চক্রের হাতে শাহাদাতবরণ করেছিলেন। আবদুল হামিদ বলেন, নতুন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে কোনো দেশের জন্যই সম্পদ। তাই তাদের সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নিজের দেশ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানাতে হবে। বাংলাদেশকে জানতে হলে বঙ্গবন্ধুকে জানতে হবে। আর বঙ্গবন্ধুকে জানতে হলে আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখন আর শুধু একটি নাম নয়; বঙ্গবন্ধু একটি প্রতিষ্ঠান, একটি কালজয়ী ইতিহাস ও একটি সত্তা। বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, নীতি ও আদর্শ, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সবাইকে আলোর পথ দেখাবে, উন্নতি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যেতে সাহস জোগাবে।

রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক অধ্যায়। এমপি হোস্টেল থেকে সকালে খবরটি শুনে কত যে কেঁদেছি! আক্ষেপ জেগেছে, বঙ্গবন্ধুকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সাবধান করেছিলাম। যত দূর মনে পড়ে, ’৭৫-এর ১১ আগস্ট বিকালে গণভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম, আমার কিছু একান্ত কথা আছে। সন্ধ্যার পর গণভবনের বাগানে হাঁটতে হাঁটতে আমার কাছে জানতে চাইলেন, কী বলতে চাস? আমি কিছু সন্দেহজনক ব্যাপার তাঁকে খুলে বললাম। বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, একটু ঝামেলা ছিল, সব ঠিক হয়ে গেছে; চিন্তা করিস না। ফিরে এলাম আশ্বস্ত হয়ে। এটাই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা, শেষ কথা। এখন বুঝতে পারি, কোনো কিছুই ঠিক ছিল না তখন।

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তাঁর নীতি ও আদর্শ মুছে ফেলা যাবে। কিন্তু তাদের সে চক্রান্ত এ দেশের মুক্তিকামী জনগণ সফল হতে দেয়নি। তাই তো জীবিত মুজিবের চেয়ে অন্তরালের মুজিব অনেক বেশি শক্তিশালী। দেশ ও জনগণের যে কোনো ক্রান্তিকালে বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শই আমাদের পথের দিশা দেখায়।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়ন ও অগ্রগতির রোল মডেল। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ আজ বাণিজ্য-বিনিয়োগ, সামাজিকসহ সব খাতেই এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে দেশ তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন আর তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত বাংলাদেশ- বঙ্গবন্ধুর ৪৫তম শাহাদাতবার্ষিকীতে এটাই সবার প্রত্যাশা। আবদুল হামিদ আরও বলেন, জাতির পিতার চিন্তা-চেতনায় সব সময় কাজ করত বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ। তিনি এ দেশের স্থপতি। ঘাতক চক্র জাতির পিতাকে হত্যা করলেও তাঁর নীতি ও আদর্শকে মুছে ফেলতে পারেনি। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন তাঁর নাম এ দেশের লাখো-কোটি মানুষের অন্তরে চির-অমলিন, অক্ষয় হয়ে থাকবে।

আবদুল হামিদ আরও উল্লেখ করেন, ’১৪ আগস্ট রাতে নানা জায়গায় আড্ডা দিয়ে এমপি হোস্টেলে ফিরি। ৩টা-৪টার দিকে ঘুমাতে যাওয়ার আগেও একাধিক আওয়াজ শুনেছি। ভেবেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনন্দ-উল্লাস হচ্ছে, পটকা ফুটছে। সকাল ৭টার দিকে পাশের রুমের খন্দকার নুরুল ইসলাম (রাজবাড়ীর এমপি) এসে দরজা ধাক্কানো শুরু করলেন। রাতে দেরিতে ঘুমিয়েছি, তাই বেশ বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই তাঁর মুখে শুনলাম ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে!’ তিনি দৌড়ে রেডিও নিয়ে এলেন। সেখানে বারবার বাজছে, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি।’ এর পরের কথাগুলো আমি আর শুনতে পারি না। আমার কান বন্ধ হয়ে আসে। মাথা ঘুরতে থাকে। আমার নেতাকে, আমার বঙ্গবন্ধুকে, বাঙালির জাতির জনককে ওরা মেরে ফেলেছে, এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আমরা চেয়ে দেখি এমপি হোস্টেলের বাইরেও ট্যাংক ঘুরছে। অনেক এমপি এবং নেতাকে ফোন করি, অনেককেই পাই না। এমপি হোস্টেলে হামলা হতে পারে, এ আশঙ্কার মধ্যেই বের হই। স্যান্ডেল পায়ে হেঁটে হেঁটে ফার্মগেটে যাই। তারপর সেখান থেকে মহাখালীতে এক আত্মীয়ের বাসায়। কিশোরগঞ্জে গিয়েছি আরও পরে।

রাষ্ট্রপতি বলেন, আমি অধিষ্ঠিত হতে পেরেছি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির আসনেও। আমার জীবনে আর কোনো চাওয়া-পাওয়া বাকি নেই। আমি শুধু চাই, এ দেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চিরঞ্জীব থাক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবদান অপরিসীম। গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি এ জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। এজন্য তাঁকে বহুবার কারাবরণসহ অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে এ দেশের জনগণকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে এ মহান নেতা ’৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এজন্য পুনরায় তাঁকে কারাবরণ করতে হয়, যেতে হয় ফাঁসির মঞ্চে। ঘাতক চক্র জাতির জনককে হত্যা করলেও তাঁর আদর্শ ও নীতিকে ধ্বংস করতে পারেনি। তিনি সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমাদের দায়িত্ব হবে দেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করে জাতির জনকের সে স্বপ্ন পূরণ করা। তা হলেই তাঁর আত্মা শান্তি পাবে এবং আমরা এ মহান নেতার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারব।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর